সকালের হাঁটাহাঁটি ও বিশুদ্ধ হাওয়ার ছোঁয়া সকালে হাঁটার পথে, হাওয়া যেন এক শুদ্ধ স্নিগ্ধতা নিয়ে আমার শরীরে স্পর্শ করছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বলতে হয়, “তুমি বল না, কেন এত দূরে গিয়েছিলে, আমি তো ছিলাম এখানে, তোমারই কাছে!” এই কথা যেন প্রকৃতি তার সমস্ত স্নেহ দিয়ে আমাকে বলেন। বিশুদ্ধ বাতাসের ছোঁয়া, যেন জীবনকে নতুনভাবে রাঙিয়ে দেয়। এই বাতাস, এই শরীরের স্পর্শ, সে যেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো হৃদয়ের গভীরে এক অপার আনন্দের উৎসব জাগায়। “মনের মধ্যে যদি এক রকমের বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে, তবে তার পরিচয় আমরা সেদিন পাই যখন সেই বাতাস আমাদের শরীরে লাগে,” — এমনই এক অনুভূতি যেন তীব্রভাবে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
গাছপালা, ফুলের গন্ধ, পাখির কিচির-মিচির — সব কিছু যেন এক অভিন্ন সুরে মিলে গেয়ে উঠছিল, এক অবিরাম সঙ্গীত, যা আমার মনের অন্তরালের সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় বলেছেন, “যত চাহি পাবে তুমি, তবে সে চাহি একা নয়, তুমি পাবে পৃথিবী, আকাশ, সব কিছু—প্রেমের মধ্যে জড়িয়ে।” প্রকৃতির এই অন্তর্গত প্রেমের অনুভূতি এক মুহূর্তে আমাকে গভীর শান্তিতে ভরিয়ে দিল।
বস্তুর ছোঁয়া, ঠাণ্ডা বাতাসের আবহ, যেন প্রকৃতির নিজের স্পর্শ, আমার সত্তার কাছে আলিঙ্গন। রবীন্দ্রনাথের এই ভাষা যেন জীবনের গভীর সত্যকে উদ্ধার করে: “বাহিরের দুনিয়া, অভ্যন্তরের চাহিদা—এই দুইয়ের মধ্যে মিলন ঘটাতে গিয়ে আমি নিজেকে খুঁজে পাই।” সেই হাঁটার পথে, হাওয়া আর ঠাণ্ডা রোদ যেন এক নিরব সঙ্গীতে মিশে গিয়েছিল, আমার মন আর শরীর একত্রে নৃত্য করছে।
আশা আর জীবনের নতুনত্বে ভরপুর সেই সময়ের স্পর্শ, যেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো “অন্ধকারে আলোর দ্যুতি।” প্রকৃতির এই স্বাভাবিক অনুশাসন আমাদের জীবনের গতি নির্ধারণ করে। জীবন যখন এক অন্ধকারে ঘেরা, তখন প্রকৃতির এমন এক বিশুদ্ধ হাওয়া যেন আমাদের ভিতর থেকে নতুন আলো বের করে আনে। “তোমার মুখে ফুটে উঠুক আমার আকাশের সূর্য”, রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো যেন আজকের সকালের হাঁটার প্রতি এক গভীর বাণী হয়ে উঠেছিল।
এই পথে হাঁটতে হাঁটতে, শুধু শরীর নয়, মনও নতুন জীবন অনুভব করছিল, যেন এক অমোঘ অনুভূতির সমুদ্রের মধ্যে আমি ডুব দিচ্ছি।
আজকের সকালটি ছিল যেন বসন্তের এক রূপকথা, এক আশার প্রতীক। শীতের মৃদু বিদায়ের পর, নতুন এক প্রাণের ছোঁয়া এসে আমাদের চারপাশকে জড়িয়ে ধরেছে। সেই মুহূর্তে, আকাশে সোনালী রোদ আর বাতাসে শীতল ছোঁয়া—সব কিছু যেন বলছিল, বসন্ত এসেছে, আর প্রকৃতি তার নতুন সাজে সেজে উঠেছে। এমন এক সকালে, যখন আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে বের হলাম, পুরো পরিবেশ যেন প্রাণে প্রাণে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। আমাদের চারপাশের সবুজ অরণ্য, ফুলের মিষ্টি গন্ধ, আর সজীব পাখিদের কিচির-মিচির শব্দ যেন সব কিছু মিলিয়ে এক বিশাল সঙ্গীত তৈরি করেছিল। বাটালি হীলের অরণ্যভরা পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, যেন প্রকৃতি তার গল্প বলে যাচ্ছে, একেকটি পাতা, একেকটি ফুল, আর একেকটি পাখি তার নিজস্ব সুরে গান গাচ্ছে। আজকের সকালে, আমি অনুভব করছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে এক অদ্ভুত সংযোগ। গাছের ডালে বসে থাকা কোকিলের সুমধুর কুহ কুহ ডাক যেন পুরো মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তার সেই মিষ্টি সুর শোনার জন্য যেন মন খুব করে আকুল হয়ে উঠছিল।
আজকের সকালে, পায়ের নিচে পড়া শুষ্ক পাতাগুলোর মচমচে শব্দও ছিল এক বিশেষ আনন্দের সঙ্গী। প্রতিটি পদক্ষেপে, যেন পৃথিবী এক নতুন রূপে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করছিল। চট্টগ্রামের বাটালি হীলের এই সবুজ অরণ্য, যেখানে প্রতিটি গাছ, পাখি এবং ফুল একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, সেখানে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল—সব কিছু যেন এক নিঃশ্বাসে মিলিয়ে গেছে, এক বিশাল সমন্বয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য। হাঁটার সময়, হালকা উত্তাল বাতাসে শরীরটা যেন এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি লাভ করছিল। প্রকৃতি আমাদের দিকে যা কিছু বিলিয়ে দিচ্ছিল—সেখানে ছিল বসন্তের আসন্ন বার্তা, ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা, আর অন্তরের গভীরে এক শান্তি। আর, এই শান্তির সঙ্গে মিলেমিশে শুরু হলো নতুন ভালোবাসার খেলা। বসন্তের এই প্রথম দিনে, যখন পহেলা ফাগুনের প্রভাতের আলো ভোরের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন আমার মনে হলো—এই দিনটিকে হৃদয়ের গভীরে যত্নে ধারণ করতে হবে।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের এক বিশেষ মুহূর্ত সামনে আসছে, ১৪ই ফেব্রুয়ারি, যখন আমরা আমাদের প্রিয়জনদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করব, তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব বিশেষ কিছু মুহূর্ত। তবে, মনেও রাখতে হবে, এই ভালোবাসা যে শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শবে বরাতের রাতে, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও দয়ালুতা প্রকাশের সময় এসে গেছে। প্রকৃত ভালোবাসা তা-ই, যা মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে।
আজকের সকালে হাঁটতে হাঁটতে, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আমাকে প্রকৃতির সান্নিধ্য আর ভালোবাসার শুদ্ধতা থেকে আরো কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। তীব্র শহরের একঘেয়েমি থেকে সরে, প্রকৃতির মাঝে এক নতুন জীবন খুঁজে পাওয়ার অনুভূতি আমাদের সকলের জীবনে প্রয়োজনীয়। বসন্তের এই সকালে, যখন আমরা নিজেদেরকে প্রকৃতির মাঝে মিশিয়ে দিয়ে প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করি, তখন আমাদের জীবনও তার পূর্ণতা পায়।
অতএব, আজকের এই সকালে, বসন্তের সৌন্দর্য আর ভালোবাসার শক্তি একে অপরকে সুসংগতভাবে একাকার হয়ে আমাদের জীবনে সত্যিকার শান্তি এবং আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। শীত যাই যাই করছে। ফাগুনে গাছে গাছে দেখা দিয়েছে সবুজ পাতা। ফসলের মাঠ সবুজে ছেয়ে আছে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। সবুজের মাঝে চারদিকে তাকালেই চোখে পড়ে লাল শিমুল ফুল। প্রকৃতিতে বইছে দখিনা বাতাস। কোকিলের সুমিষ্ট কুহুতানে ফাগুনের উত্তাল হাওয়া দিচ্ছে দোলা। শিমুল ফুলে এখন বসন্তের হাসি। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতি সেজে উঠে নয়নাভিরাম শিমুল ফুলে। সারা দেশের প্রকৃতিতে দেখা মেলে এমনই রূপ। এ দৃশ্য মন কেড়েছে প্রকৃতি প্রেমিকদের। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তায়, পতিত ভিটায় প্রচুর শিমুলগাছ দেখা যায়। গাছে গাছে প্রস্ফুটিত শিমুল ফুলই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, এসেছে বসন্ত। নানা ছন্দে কবি-সাহিত্যিকদের লেখার খোরাক জোগাত রক্তলাল এই শিমুল ফুল। শিমুল ফুলের সঙ্গে এ দেশের মানুষের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মনের অজান্তেই শিমুল ফুলের সঙ্গে গড়ে উঠে মিতালি। ছোট-বড় সবাই এই শিমুল ফুলকে পছন্দ করে। গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষের সঙ্গেই শিমুল ফুলের কিছু না কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ছোটবেলায় এই শিমুল ফুল দিয়েই নানা রকম খেলায় মেতে থাকত শিশুরা। কিন্তু কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার প্রকৃতি থেকে এখন বিলুপ্তপ্রায় শিমুলগাছ। বর্তমানে শিমুলগাছ খুব একটা চোখে পড়ে না।
শিমুলকে ঔষধি গাছ হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। গ্রামাঞ্চলের মানুষ বিষফোঁড়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে গাছের মূলকে ব্যবহার করত। আখের গুড় তৈরিতে শিমুলের রস ব্যবহার হতো একসময়, বর্তমানে নানা কারণে তা হ্রাস পেয়েছে। শিমুলগাছ কেউ রোপণ করে না, এমনিতেই জন্মায়। দিনে দিনে বড় হয়ে এক দিন বিশাল আকৃতি ধারণ করে। অবহেলিত এ গাছকে কেউ তেমন যত্নও করে না। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলেও শিমুলের কদর অনেক। গ্রামবাংলার এই শিমুলগাছ অনেককে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এনে দিত। হতদরিদ্র মানুষ এই শিমুল তুলা কুড়িয়ে বিক্রি করত। তুলা দিয়ে বানাত লেপ, তোশক ও বালিশ। শিমুলের তুলা বিক্রি করে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছে এমন নজিরও আছে। শিমুল তুলার কদর এখনো রয়েছে। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে গাছ না থাকায় পর্যাপ্ত তুলা পাওয়া যায় না।
আগের তুলনায় এখন শিমুলের তুলার দাম অনেক বেড়ে গেছে। এর পরও এই গাছ নিধন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে কারণে গ্রামবাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে অতি পরিচিত শিমুলগাছ। সকালে ঘুম থেকে উঠে শিমুলের চিরচেনা রূপ আর চোখে পড়ে না। আমাদের সবার উচিত শিমুলগাছের যত্ন নিয়ে এ গাছকে বাঁচিয়ে রাখা।