স্মৃতির সোনালি সড়কে বন্ধু আমার- এই সোনালী সড়ক দিয়ে কতদূর যাওয়া যায় তা দেখি- চলুন পথ চলি-
এটি মিতা কামাল হোসেনের স্মৃতিময় কথার অনুরণন। বহু বছর আগে, এক শুভক্ষণে আমার সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সূচনা হয়। সেই বন্ধুত্ব কখনোই খুঁটি না হারানো সম্পর্কের মতো পোক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনের পর দিন, আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে, যেন সময়ের প্রবাহে তার সৌন্দর্য বেড়েই চলেছে। তিনি শুধু একজন সুশিক্ষিত সুনাগরিকই নন, বরং সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের প্রতি তার এক গভীর প্রেম রয়েছে। তার হৃদয়ে কোনো হীনম্মন্যতা বা অহংকারের স্থান নেই—সে তো মধুরতায় ভরা, এক নিবেদনশীল মানুষ, যার হাসিতে থাকে অনন্ত মাধুর্য।
সবচেয়ে অদ্ভুত যে বিষয়টি তা হলো, তিনি আমার লেখার একজন নিবেদিত ভক্ত। প্রতিদিন কোনো না কোনো লেখা নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ হয়, যেন লেখা থেকে কিছু না কিছু নতুন কিছু শিখে যেতে চাই। একসময়, নরসিংদির হাসনাবাদ এলাকায় এক অতি দুরূহ পরিস্থিতিতে তিনি আমাকে রক্ষা করেছিলেন, আর সেই ঘটনা আমি কখনো ভুলতে পারব না—একটি মহৎ আত্মা যেভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তা যেন জীবনের এক অমূল্য রত্ন।
আজ, বহুদিন পর ঢাকা পলওয়েল মার্কেটে আমাদের দেখা হলো। তাকে আমি আমার এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ‘সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র’ বইটি উপহার দিলাম, আর সে তার প্রাপ্য প্রতিদানে আমাকে উপহার দিল একটি সুন্দর গেঞ্জি। তার হাসি আর মিষ্টি কথাগুলো যখন আমার কানে পৌঁছায়, তখন মনে হয়, প্রতিটি শব্দ যেন সোনালী রেশমের মতো হৃদয়ে ঝংকৃত হয়। সেই হাসির মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি, এক অদৃশ্য বন্ধন, যা আমায় আরও কাছে টেনে নিয়ে আসে। কামাল ভাই একজন সফল ব্যবসায়ী, কিন্তু তার মনন যেন এক সাহিত্যিক রসের সাগর। তার মধ্যে সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং মানবিকতার প্রতি এক গভীর আকর্ষণ রয়েছে, যা তাকে অন্যসব মানুষের থেকে আলাদা করে তোলে। এই নিয়ে আমি একদিন আরও বিস্তারিত লিখবো, কিন্তু আজকের লেখাটি তার শৈশবের কিছু অনবদ্য স্মৃতির স্মরণে রচিত। তার শৈশবের আরিয়াল খা নদী, সেই নদীর তীরে তার বিদ্যালয়ের দিনগুলো, এসব কথা তার মুখে উঠে আসে, যেন এক মিষ্টি সুরের মতো, যা হারিয়ে না যেতে চায়। এই স্মৃতিরূপে বেঁচে থাকে তার জীবনের এক বিশেষ মুহূর্ত, যা প্রতিটি পাঠককেও একটি বিশেষ অনুভূতির জগতে নিয়ে যাবে।
আমার শৈশবের স্মৃতিগুলো, জীবনের এক অমূল্য রত্ন। যখনই আমি সেই সোনালী সড়ক ধরে হাঁটি, যেখানে কৈশোরের খেলা এবং বন্ধুত্বের অমূল্য মুহূর্তগুলো তৈরি হয়েছিল, তখন মনের মধ্যে একটি গাঢ় অনুভূতি জাগে। একে একে প্রিয় বন্ধুদের মুখ, সেই রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল, মায়ের আদর, আর সেই বিদ্যালয়ের শান্ত পরিবেশ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আজও যেন সেই সময়ের বাতাস, সেই স্কুলের মাঠ, আড়িয়াল খাঁ নদী, সব যেন আজও আমার আশপাশে ঘুরছে। স্মৃতির সোনালি সড়ক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, আমি ফিরে যাই সেই দিনগুলোতে, যখন আমাদের জীবন ছিল এক টুকরো সোনালী আলো, আর শৈশবের নিরবধি আনন্দে পূর্ণ।
আজ এই স্মৃতির সোনালি সড়কে দাঁড়িয়ে, আমি বলতে চাই আমার প্রিয় স্কুল, আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা। সেখানে কাটানো সেই অমূল্য দিনগুলি, যা কখনো মুছে যাবে না। সেই স্কুল শুধু একটি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল না, বরং তা ছিল জীবনদর্শন শেখানোর এক বিশাল ক্ষেত্র। আজও আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই শিক্ষকদের, যারা আমাদের জীবনে শুধু পাঠ নয়, মানবিক গুণাবলি, আদর্শ ও নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। তারা ছিলেন এক এক অমল পাথরের মতো, যারা আমাদের জীবনে আলো জ্বালিয়ে গেছেন।
স্কুলের সেই প্রথম দিনগুলো মনে পড়ে, যখন আমরা একত্রে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করতাম, শিক্ষকরা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতেন, আর আমরা আমাদের বন্ধুদের সাথে হাসিমুখে কথা বলতাম। সেই দিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এতসব কিছুর মূল্য, যেগুলো জীবনকে নানা উপায়ে শিখিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের প্রধান শিক্ষক, পরম শ্রদ্ধেয় গন্দকার আবু হান্নান স্যার, রহমান স্যার, কনির বি.এসসি, হোসেন স্যার, হক স্যার, লতিফ হুজুর, সামসুদ্দিন স্যার, ইসমাইল কেরামী স্যার—তাদের প্রত্যেকের অবদান ছিল অমূল্য। তাদের সততা, নিষ্ঠা, এবং আদর্শ আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। তারা ছিলেন আমাদের জীবনের নায়ক, যারা সত্যিকারের শিক্ষক হিসেবে আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে প্রকৃত মানুষ হতে হয়।
এছাড়া, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, আমরা অনেক প্রিয় বন্ধু ও সহপাঠী হারিয়েছি। বিশেষ করে, আমার প্রিয় বন্ধু হাসান, যাকে আমি কখনো ভুলতে পারব না। তার সাথে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলো, তার সঙ্গে হাসি-খুশি, এবং প্রিয় স্মৃতিগুলো আজও মনে পড়ে। সেই দিনগুলোর পর, মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিকান্ডে হারানো দেশের ৩০ লক্ষ শহীদের কথা ভাবলে আজও হৃদয়ে ব্যথা আসে। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের জন্য একটি অমূল্য উপহার।
এছাড়া, আমি বিশেষভাবে স্মরণ করি গনি মিয়া, যিনি কৃষক ছিলেন, আর তার সন্তান, যিনি এখন দুবাইয়ে বসবাস করেন। গনি মিয়ার কঠোর পরিশ্রম, সংগ্রাম এবং তার আত্মবিশ্বাসের গল্প আমাকে জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোতে শক্তি দেয়। এই সমস্ত মানুষই আমাদের সমাজের অমূল্য রত্ন, যারা নিজেদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রমে নিজেদের জীবন গড়েছেন।
স্কুল জীবনের এক চমৎকার দিক ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমাদের একসঙ্গে স্কুলে যাওয়ার, মাঠে খেলাধুলা করার, নদীতে মাছ ধরার স্মৃতি আজও মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকে। আজও মনে পড়ে সেই কলাগাছের ভেলায় ভেসে যাওয়া, বৃষ্টিতে ভিজে মাছ ধরা, এবং মনের আনন্দে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়া। এসবই ছিল শৈশবের অমূল্য রত্ন। তবে, স্কুলের মাঠ, আড়িয়াল খাঁ নদী, আর সবুজ গ্রামে যাওয়া—এগুলোই ছিল আমাদের শৈশবের সোনালি দিনগুলো।
আমাদের দেশ এবং তার ইতিহাস, বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের গর্ব ও গৌরবের উৎস। ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মানুষ যে অবিস্মরণীয় ত্যাগ করেছে, তা এক অনন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমি আজও মনে করি, তাদের ত্যাগই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতি, দেশপ্রেম এবং আমাদের জাতীয় চেতনা আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। আজকের দিনে, বর্তমান সমাজের মধ্যে প্রয়োজন সত্যিকারের সৎ নেতৃত্ব। আমরা যদি সঠিকভাবে দেশকে পরিচালিত করতে চাই, তবে আমাদের প্রয়োজন এক যোগ্য নেতা, যিনি দেশের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। আমাদের দেশ এবং সমাজে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, দৃঢ় মনোবল এবং সঠিক শিক্ষা অপরিহার্য।
এছাড়া, আমি আমার প্রিয় অধ্যক্ষ মোঃ নূর সাখাওয়াত হোসেন মিয়াকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। দীর্ঘ আঠারো বছর তিনি বিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে, প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। তার অসম্ভব নিষ্ঠা এবং সাহসিকতার জন্য বিদ্যালয়টি আজ দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার নেতৃত্বের মধ্যে রয়েছে সাহস, দৃঢ়তা এবং এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি, যা আমাকে এবং অন্যদেরকে আজও অনুপ্রাণিত করে।
অবশেষে, আমি আমার জীবনের সেই বন্ধু মিতা কামাল হোসেনের কথা স্মরণ করি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে একে অপরকে জানি, এবং আমাদের মধ্যে এক গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। তার সাথে স্মৃতির আদান-প্রদান, এবং বই উপহার দেওয়ার কথা—এগুলো সবই জীবনের অমূল্য মুহূর্ত। আমি আজ তাকে এক বিশেষ উপহার দিয়েছি, আমার লেখা এই বইটি, এবং তিনি আমাকে একটি সুন্দর গেঞ্জি উপহার দিয়েছেন। এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিক, যা কখনো ভোলা যায় না। শেষে, আমি বলতে চাই—জীবনের এই পথচলায় আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু হারিয়েছি, কিছু পেয়েছি। তবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, আমাদের স্মৃতির সোনালি সড়ক—যা আমাদের শৈশব, শিক্ষা, বন্ধু, এবং দেশের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। এই পথচলা কখনো থামে না, বরং আরও নতুন নতুন স্মৃতি তৈরি হয়, যা চিরকাল আমাদের হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকে।
লেখক পরিচিতি: জি.এম. কামাল হোসেন (১৯৭৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী)
এই লেখাটি আমি আমার প্রিয় বন্ধু মিতা কামাল হোসেনকে নিবেদিত করছি। তিনি শুধু আমার লেখার একজন নিষ্ঠাবান পাঠক নন, বরং সাহিত্যের প্রতি তার অন্তহীন ভালোবাসা ও অগাধ ভালোবাসা আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে। তার স্নেহময় প্রেরণা ও অনুৎসাহ আমাকে সাহিত্যের অজানার পথে চলার সাহস যুগিয়েছে। মিতা আমার জীবনে এক অমূল্য রত্নের মতো, যার উপস্থিতি আমাকে সবসময় লেখার জন্য উৎসাহিত করেছে। তার নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও সাহিত্যের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা আমাকে সৃজনশীলতার এক নতুন দিগন্ত দেখিয়েছে, যার জন্য আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ।