“”হৃদয়ের মাধুর্য আর জীবনের রূপান্তর—দীপিকা বড়ুয়ার হৃদি কথন
এক জীবন্ত কাব্যসম্ভার, যেখানে শব্দ হয়ে ওঠে আত্মার ভাষা””
প্রত্যেক কবির কণ্ঠে সময়ের এক আলাদা ধ্বনি থাকে, যা তাঁর জীবন, অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও ভালবাসা থেকে উঠে আসে। কবি দীপিকা বড়ুয়া সেই বিরল কবিদের একজন, যাঁর কবিতায় ধরা পড়ে হৃদয়ের মৌন ভাষা, সংসারের আত্মিক ছায়া এবং জীবনের সহজিয়া রূপ। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদি কথন’ যেন একটি খোলা জানালা—যেখান দিয়ে পাঠক ঢুকে পড়ে এক শান্ত অথচ গভীর অন্তর্জগতের ভেতরে।
দীপিকা বড়ুয়ার জন্ম চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সুচিয়া গ্রামে, এক সাংস্কৃতিক আবহে। পিতা ছিলেন চাকরিজীবী হলেও একই সঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের একনিষ্ঠ সাধক। মা ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ গৃহিনী। এমন একটি পরিবেশে জন্ম নিয়ে কবির অন্তরজগতে যে নরম আলো গেঁথে গিয়েছিল—তারই প্রতিচ্ছবি আমরা পাই তাঁর কবিতায়। শৈশব থেকে শুরু করে শিক্ষকজীবন, সংসার, সমাজ ও সময়—সবকিছুই কবির কবিতায় ধরা দিয়েছে নিঃসঙ্কোচে, নিঃশব্দে।
কবি দীপিকা বড়ুয়া শুধু একজন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক নন, তিনি হলেন সেই চিরসবুজ সত্তা, যিনি অবসরের গহন নীরবতায় খুঁজে পেয়েছেন নিজের কণ্ঠস্বর। ‘হৃদি কথন’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যেন নিজেই নিজের ছায়ার সাথে কথোপকথনে লিপ্ত হয়েছেন—কখনো মৃদু স্বরে, কখনো ক্ষীণ অভিমানে, আবার কখনো প্রজ্ঞায় দীপ্ত এক সংহত উচ্চারণে।
এই গ্রন্থে রয়েছে মোট ৬৪টি কবিতা, যার প্রথম কবিতা “আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল”—এই একটি পঙক্তির মধ্যেই ধরা পড়ে কবির কবিতাজীবনের সারসংক্ষেপ। তিনি ব্যাকুল হয়ে বলতে চান—তাঁর দেখা, শোনা, অনুভব করা জীবনগাঁথা। প্রতিটি কবিতাই যেন একটি হৃদয়ের প্রতিধ্বনি।
এই কাব্যে প্রেম আছে, কিন্তু তা ছলনাময় বা নিছক রোমান্টিক নয়—বরং গভীর, পরিণত এবং মানসিক সংলাপে পূর্ণ। যেমন একটি পঙক্তি বলছে:
“ভালোবেসে দেখেছি, হৃদয় কেবল গ্রহণ নয়, বিসর্জনেরও নাম”
এই এক পঙক্তিতেই কবি তুলে ধরেছেন প্রেমের গূঢ়তম দর্শন। তাঁর কবিতার প্রেম যেন অন্তঃশীলা নদীর মতো—নিভৃতে বয়, কিন্তু তীব্র আবেগে পুষ্ট।
‘হৃদি কথন’-এর আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো জীবনের সৎ প্রতিবিম্ব। মৃত্যুচিন্তা, জীবনের অনিবার্যতা, সময়ের রূঢ়তা—এসব বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সাহসিকতায়, কিন্তু করুণায় মোড়ানো। শেষ কবিতা “মৃত্যুর ভয়” যেন এক মৃদু প্রার্থনার মতো, যেখানে কবি বলেন,
“ভয় নয়, প্রস্তুতি চাই—মৃত্যুর জন্য নয়, মুক্তির জন্য!”
এই কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে বোঝা যায়, কবির লেখনীতে কোনো বাহুল্য নেই। যা বলার তা-ই বলেন—সোজা, স্বচ্ছ ও হৃদয়ছোঁয়া ভাষায়। কখনো ধর্মীয় ভাবনায়, কখনো নারীর আত্মকথনে, কখনো সমাজজীবনের ছায়ায় তিনি তার কবিতাগুলিকে জীবন্ত করে তোলেন। আমার হাতে এই বই আসে এক বিশেষ সন্ধ্যায়, চট্টগ্রাম একাডেমি হলে আয়োজিত একটি সাহিত্যসভায়, যেখানে সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন চট্টগ্রামের আদি ভাষা ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সেই সভায় কবি দীপিকা বড়ুয়া নিজ হাতে আমাকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ উপহার দেন। আমি কবিতা লেখি না, তবে কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আর এই বইটি পড়তে গিয়ে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম—শব্দের মধ্যে, অনুভবের মাঝে, কবির হৃদয়পটভূমিতে।
তিনি শুধু কবিতা লেখেন না, জীবনকে লিখে ফেলেন কবিতায়। তাঁর লেখায় সময়ের এক হাহাকার থাকে, কিন্তু সেই হাহাকার হয়ে ওঠে প্রতিরোধের ভাষা—যা মানুষকে জাগাতে চায়, ভাবাতে চায়, ওড়াতে চায়।
‘হৃদি কথন’ কেবল একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, এটি একান্ত নিজস্ব এক জগত—যেখানে পাঠককে স্বাগত জানানো হয় শব্দের আলোয় ভেজা মেঘলা প্রহরে। এটি সেই বই, যা একবার পড়লে মন চায় বারবার পাঠে ফিরে যেতে, যেন নিজের ভেতরেই কিছু খুঁজে পাওয়া যায়। কবি দীপিকা বড়ুয়া আমাদের মনে করিয়ে দেন—শব্দ একমাত্র তখনই জীবন্ত হয়ে ওঠে, যখন তা আসে হৃদয় থেকে।
আজকের সময়ের ব্যস্ত, অস্থির ও প্রান্তিক জীবনের ভিড়ে দাঁড়িয়ে দীপিকা বড়ুয়ার মতো কবি আমাদের মনে করিয়ে দেন—তStill writing… he ভালোবাসা, সত্য, অনুভব ও বিশ্বাসই সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ চেতনাপ্রবাহ। ‘হৃদি কথন’ সেই চেতনারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন।