আমাদের সব স্বাধীনতা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের প্রধান অ্যান্তনিও গুতেরেস। ৩ মে বুধবার বিশ্ব সংবাদপত্র স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এক টুইট বার্তায় এমন মন্তব্য করেন তিনি।গুতেরেস বলেন, বিশ্বের প্রতিটি কোণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আক্রমণের মুখে রয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সংস্থার প্রধান বলেন, বিশ্ব সংবাদপত্র স্বাধীনতা দিবসে এবং প্রতিদিন বিশ্বকে সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ তারা সত্যের পক্ষে। ৩ মে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা ‘বিশ্ব সংবাদপত্র স্বাধীনতা দিবস’ পালন করা হয়। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হয়। এই দিনটিতে স্মরণ করা হয় খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে মৃত্যু বরণকারী কিংবা কারাবরণকারী সাংবাদিকদের।দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাংবাদিক সংগঠণগুলো সভা-সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।
কিছু দেশে, নির্দিষ্ট বিষয়গুলির প্রতিবেদনগুলি সরকার কর্তৃক বাধা বা প্রতিরোধ করা হয়। সরকারি তথ্যের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে যে কোনও সরকার পৃথক করতে পারে কোনটি প্রকাশ্য বা জনসাধারণের কাছে প্রকাশ থেকে সুরক্ষিত থাকা উচিত। রাষ্ট্রীয় উপকরণ দুটি কারণে যে কোনও কারণে সুরক্ষিত: সংবেদনশীল, শ্রেণিবদ্ধ বা গোপন হিসাবে তথ্যের শ্রেণিবিন্যাস বা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় তথ্যের প্রাসঙ্গিকতা বিষয়গুলো সংবাদপত্রের জন্যে লক্ষ্যণীয় বিষয়। অনেক দেশের সরকার “সানসাইন ল” বা তথ্যের স্বাধীনতা আইনেরও অধীন যা জাতীয় স্বার্থের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করতে এবং নাগরিকদেরকে সরকার পরিচালিত তথ্যে আদান প্রদানের সুযোগ দিতে সহায়তা করে।
জাতিসংঘের ১৯৪৮সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে: “প্রত্যেকের মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে; এই অধিকারে হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত রাখা, এবং কোনও গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য ও ধারণাগুলি অনুসন্ধান করা, গ্রহণ এবং গ্রহণের স্বাধীনতার সীমানা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত”। এই দর্শনটি সাধারণত আইনসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বাধীনতা ( বৈজ্ঞানিক স্বাধীনতা হিসাবে পরিচিত), প্রকাশনা এবং প্রেসের বিভিন্ন ডিগ্রি নিশ্চিত করে এই আইনগুলি একটি দেশের আইনী ব্যবস্থায় যে গভীরতায় আবদ্ধ রয়েছে তা সংবিধানের যতটা নিচে যেতে পারে। বাকস্বাধীনতার ধারণাটি প্রায়শই প্রেসের স্বাধীনতার মতো একই আইনের আওতায় আসে, যার ফলে কথিত এবং প্রকাশিত মত প্রকাশের জন্য সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। সুইডেন বিশ্বের প্রথম দেশ যেটি ১৭৬৬ সালের ফ্রিডম অফ প্রেস অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রেসের স্বাধীনতাকে তাদের সংবিধানে সংরক্ষণ করেছিল ।
৩ মে, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে, জাতিসংঘের মহাসচিব বুট্রোস ঘালি ১৯৯৩ সালে সাধারণ অধিবেশনের এক সভায় এই দিবসটি পালনের ঘোষণা প্রদান করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালিত হয়। সংবাদপত্রকে আধুনিক সভ্যতার দর্পণ বলা হয়। প্রভাতে সূর্য ওঠার সাথে সাথে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী যেমন আলোকদীপ্ত হয়ে ওঠে, তেমনি রাতের অন্ধকার বিলীন হওয়ার সাথে সাথে আমাদের দ্বারে সংবাদপত্র পৌঁছে যায়। নিত্য নতুন খবর ও জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হয় পাঠকের মন।
সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে অনেকই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কখনই অর্থবহ হয় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের মানবাধিকারেরই অংশবিশেষ। তাই সাংবাদিককে মানবাধিকার কর্মীও বলা যেতে পারে। স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ, মানবাধিকার উন্নয়ন ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। একটি দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হলে গণতন্ত্র বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আমেরিকার নির্বাচনে দুবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেফারসন বলেছিলেন, তাকে যদি সংবাদপত্রহীন সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্র বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রের জগৎই বেছে নেবেন। শুধু তাই নয়, সংবাদপত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে সংবাদপত্রের কঠোর সমালোচনাও হজম করতে পেরেছিলেন জেফারসন। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পরও তিনি সংবাদপত্রের প্রতি শ্রদ্ধা হারাননি। জেফারসন আবারও বলেন, ‘সংবাদপত্র যেখানে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে এবং জনসাধারণ যেখানে পড়তে জানে সেখানে সবকিছুই নিরাপদ’। বিশ্বের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিনোদনসহ মানব সমাজের যাবতীয় আবশ্যকীয় বিষয়গুলোর সঞ্চার ঘটে সংবাদপত্রে। আর পৃথিবীর যেখানেই কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় সেখানেই সংবাদপত্রের বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কলম গর্জে ওঠে। তাই সংবাদপত্র সমাজের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, আবালবৃদ্ধবনিতাসহ সকল শ্রেণীর লোকেরই জ্ঞান বৃদ্ধি ও মনের কৌতূহল মিটিয়ে থাকে। সভ্যতার সার্বিক বিকাশের প্রয়োজনেই সংবাদপত্রের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা ও সংবাদপত্র একটি ঝুঁকিবহুল শিল্প। যেখানেই সমাজবিরোধী, দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থান্বেষী অশুভ চক্রের ষড়যন্ত্র, সেখানেই সাংবাদিকরা তৎপর হন। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা অনন্য সাধারণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। সাংবাদিক জাতির বিবেক এবং পাঠক সংবাদপত্রের প্রাণশক্তি। কেননা জনগণের ভাবনার প্রতিফলন ঘটে সংবাদপত্রে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি আপেক্ষিক। তবে সংবাদপত্রের ওপর অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষত চাপ সৃষ্টি নিশ্চিতভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে। এখন হামেশাই নানাভাবে রোষানলে পড়তে হয় সংবাদকর্মীদের। এমন এক সময় এবার ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম দিবস পালিত হচ্ছে যখন বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের ওপর সরকার ও প্রভাবশালী মহলের নানা ধরনের চাপ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অনেকটাই বৃত্তবন্দি হয়ে পড়েছে। ১৯৭৩-এ প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট ও জেলা প্রশাসকদের হাতে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করার ঘটনা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কোনো সময়ই সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতা ছিল না। আজ সংবাদপত্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেন্সরশিপ, প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন কালাকানুন। গণমাধ্যমের কার্যালয়ে পুলিশের মারমুখী অনুপ্রবেশ, কর্মরত সাংবাদিককে চোর-ডাকাতের মতো আটক, এমনকি সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ এবং প্রেস পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা ঘটেছে।বলাবাহুল্য, যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি সেখানে গণতন্ত্র তত বেশি স্বচ্ছ। জনগণ তাদের দুঃখ ও সমস্যার কথা সংবাদপত্রের মাধ্যমে সরকারকে অবহিত করার সুযোগ পায়। তবে নির্ভীক, স্বাধীন সংবাদপত্র ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ একসঙ্গে চলতে পারে না। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যারা জোর গলায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলেন, ক্ষমতায় গেলে তারাই বিভিন্ন ছলে-বলে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করে থাকেন। বর্তমান সময়েও দায়িত্ব পালনের সময় সন্ত্রাসী হামলা, কারাবরণ, হত্যাকা-ের শিকারসহ সহস্রাধিক সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হামলা-মামলা নিয়ে অনেক সাংবাদিককে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আমাদের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মর্যাদা বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। উল্টো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রশক্তির রোষানলে পড়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হন। যদিও মত প্রকাশ তথা বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকারের ওপর। কিন্তু রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব মোটেই আন্তরিকতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করছে এমনটা পুরোপুরি বলা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র ও জাতীয় প্রচার মাধ্যমের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। একের পর এক সাংবাদিক হত্যা, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ, সত্য প্রকাশে নির্ভীক সম্পাদকদের ওপর জেল-জুলুমের স্টিম রোলার, পরমতে অশ্রদ্ধা ও গালিগালাজ, টিভি-চ্যানেল তথা গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন ইত্যাদি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। নানা চাপ ও ভীতির মধ্যে সংবাদকর্মীদের কাজ করতে হয়। একদিকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে। প্রতিটি সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার মাধ্যমের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। সরকার ও প্রশাসনে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনায় বাধা সৃষ্টি করার প্রবণতা রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেন্সরশিপ, প্রেস অ্যাডভাইসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা, দুর্নীতিবাজরা গণমাধ্যমের কাজে নিয়মিত হস্তক্ষেপ করছে। একটা সংবাদের পেছনে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, সাহসিকতা আর মেধার সমন্বয়ে সবার সামনে সত্য প্রকাশ হয় তাদের সম্পর্কে এখনো আমরা যত্নশীল নয়। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাদানে কুণ্ঠিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। অথচ সারা বিশ্বে একে বাধাদান করার জন্য সরকার ও শাসক শ্রেণীর অভাব নেই। অনেক সাংবাদিক সম্মানহানি ও বন্দি হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও কাজ করেন শুধু সর্বসাধারণের অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য। তারা যে কোনো অবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে, দুর্নীতির খবর ফাঁস করলে, ঘুষ, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিসহ সরকারি দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনৈতিক ও জিঘাংসামূলক অবস্থানের চিত্র তুলে ধরলে ক্ষমতাসীনদের চোখে সেটা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়। সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন সব সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর মত প্রকাশের স্বাধীনতা শতভাগ মসৃণ নয়। বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে এখনো সুবিধাবাদীদের রক্তচক্ষু এমনকি শেষ পরিণতিতে নির্মম মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার পাশাপাশি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা বাঞ্ছনীয়। এ কথা অনেকটাই ঠিক যে, বর্তমানে সংবাদপত্র প্রকাশের লক্ষ্যই হচ্ছে লাভবান হওয়া। আর্থিক লাভ, সামাজিক প্রভাব, সেও প্রকারান্তরে লাভ। আর এমনটিই যদি হয় মুখ্য, তাহলে দায়বদ্ধতার বিষয়টি আর থাকে না, থাকতে পারে না। সংবাদপত্রকে শুধু ব্যবসার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখলে চলে না। সংবাদপত্রের একটি সামাজিক দায় রয়েছে। এ দায়টা হলো কোনো তথ্য জানার অধিকার থেকে পাঠককে বঞ্চিত না করা। তবে মত প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কিছু করা উচিত নয়; যার জন্য একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যাহত হয়। জানার অধিকার এবং গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে সবসময় একটি ভারসাম্য রেখে চলতে হয়। এর অন্যথা হলে সংবাদপত্র আর সংবাদপত্র হিসেবে বিকশিত হতে পারে না। তা হয়ে পড়ে নিছক সংবাদ বাহক। সমাজের দর্পণ যদি সমাজ পরিবর্তন না করে কলুষই করল, তবে তার দায়বদ্ধতার বিষয়টি নিছক বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। সমাজবিচ্ছিন্ন সংবাদপত্র তখন আর কোনো বাস্তব সামাজিক উপাদানকে ধারণ করতে পারে না। সংবাদপত্র তখন ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন দেশ ও রাজনীতির স্বার্থে গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন নিয়ে বিতর্ক থেকে যায়। সংবাদপত্র যত বেশি নিরপেক্ষ হবে এবং সাংবাদিকরা যত বেশি নির্ভীক ও সৎ হবেন দেশ ও জাতির জন্য তত বেশি মঙ্গলজনক হবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে
মামলা-গ্রেপ্তার প্রভৃতি নিয়ে গত কিছুদিন ধরে নানা আলোচনা, সমালোচনা, টিভির টক শোতে ঝড় বইছে। দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা অপিরহার্য। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারের ভুলত্রুটি যেমন সংবাদপত্রে তুলে ধরা দরকার; তেমনি সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করে সংবাদ, সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ হওয়া দরকার। কিন্তু অনেক সময় কোনো কোনো সংবাদপত্র, সংবাদ মাধ্যম সরকারের ভালো কাজের প্রশংসার পরিবর্তে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা, বিভ্রান্তি মূলক সংবাদ, সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। অনেক সময় মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতকে কটাক্ষ করে সংবাদ প্রকাশ করে। একইভাবে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনকালে নেতাকর্মীদের হাতে লাঠি ও মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে সাধারণ মানুষের ওপর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর, পার্শ্ববর্তী দোকান, শপিংমলে হামলা, যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে লিপ্ত হওয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখি। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় স্বাধীনতা দিবসের দিন মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাও আবার মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত ওই সংবাদে একজন শিশুর হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তাকে দিয়ে শেখা কথা বলানোর চেষ্টা অন্যলোকের কণ্ঠে বক্তব্য প্রকাশ করে সংবাদপত্র জগতে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। একই সঙ্গে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ভূমিকাকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি সংবাদ প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক, সম্পাদকের দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি, দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দায়িত্ব জ্ঞানহীন এরকম একটি নির্জলা মিথ্যা, কল্পকাহিনিকে সংবাদ আকারে প্রকাশের পর একজন সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেকেও অপরাধী মনে করছি। তবে আশার কথা হচ্ছে, ওই দৈনিকের দায়িত্বহীন, মিথ্যাচারে দুষ্ট অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে পেশাজীবী, সাংবাদিক সংগঠনগুলো, নাগরিক সমাজ, বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, জাতীয় প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিবাদে স্বোচ্চার। তারা এ ধরনের হলুদ সাংবাদিকতা বন্ধের পাশাপাশি দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনারও দাবি জানিয়েছেন। কোনো অপপ্রচার, অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ নিকট অতীতে এটাই প্রথম। অবশ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বন্ধেও সাংবাদিক সংগঠনগুলো সরকারের কাছে তাদের অবস্থান ও তুলে ধরে। প্রশ্ন হচ্ছে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র সরকারের সমালোচনা, সরকারের কর্মকাণ্ড, সরকারি দলের এমপি, মন্ত্রীদের কর্মকাণ্ড, বক্তব্য-বিবৃতি নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে প্রায়ই। এ জন্য কখনো সরকারি দলের পক্ষ থেকে তেমন উচ্চবাচ্য হতে দেখিনি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠিয়ে প্রকাশিত সংবাদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে। বিগত সময়ে এ ধরনের সংবাদ সম্পাদকীয় প্রকাশ হয়েছে। আবার কখনো কখনো ওই সব সংবাদ-সম্পরদকীয় নিবন্ধের বিরুদ্ধে ভুূক্তভোগী, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের প্রতিবাদ ছাপা হয়েছে, আবার কখনো কখনো মামলা হয়েছে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ক্ষতিগ্রস্ত এমপি, মন্ত্রী বা সরকারি সংস্থা থেকে মামলা করার নজিরও আছে। সম্প্রতি প্রথম আলো সংবাদ প্রকাশের নামে আমাদের মহান স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতার বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে শেখ হাসিনা সরকারের ইতিবাচক উন্নয়ন তৎপরতা তথা সাফল্যকে হেয় করে দেখার অপপ্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। অবশ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ, ব্যবহার ও এই আইনে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে গ্রেপ্তারের আগে বিষয়টি তদন্ত, পর্যালোচনা করার দাবি রয়েছে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর এই দাবি পর্যালোচনা করে বিদ্যমান আইনের সংশোধন, সংযোজন করা প্রয়োজন। ২৭ মার্চ (২০২৩) প্রকাশিত একাত্তর টিভির ‘স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর সেই ছবি পুরোটাই ভুয়া’ শিরোনামে সংবাদে জানানো হয়েছে, দৈনিক প্রথম আলোর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাইরাল হওয়া খবরের ছবি ছিল, ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে এক শিশু। নাম জাকির হোসেন। শিশুটির উদ্ধৃতি ছিল এমন- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কি করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো।’ জাকির নামটি ভুল ছিল। আসলে সাত বছরের সবুজ নামে ওই শিশুর হাতে ১০ টাকা দিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক ছবি তুলেছেন বলে দাবি ওই শিশু ও তার পরিবারের। সাভারের কুরগাঁও পাড়ায় সবুজের বাড়ি। তার মা মুন্নী বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে মেজো সবুজের নাম কীভাবে জাকির হোসেন হলো, আর প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তানকে কেন দিনমজুর বলা হলো, তাতে তিনি অবাক হয়েছেন। রাজমিস্ত্রি বাবা আর মার আয়ে সংসার চলে। অন্যদিকে ছোট সবুজ কেমন করে জানলো বাজারের দ্রব্যমূল্যের খবর- সেটাও বিস্ময়কর। স্বাধীনতা দিবসে এমন খবরকে ১৯৭৪ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে জাল পরানো বাসন্তীর ছবির মতোই চক্রান্ত বলা হচ্ছে বিশিষ্টজনের দৃষ্টিকোণ থেকে। বাস্তবতা হলো, প্রকৃতপক্ষে অসৎ উদ্দেশে উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে একজন শিশুকে সংবাদের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশে বাসন্তী নামের একজনকে জাল পরিয়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই বাসন্তীকে যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সাজানো হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও টেলিভিশন উপস্থাপক মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।