দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারের নিঃসঙ্গতা, গাঢ় অন্ধকার আর নির্জনতার পর মুক্ত বাতাসে ফিরে আসা এক মানুষের অনুভূতি কেমন হতে পারে? হয়তো তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, কিন্তু নাছির ভাইয়ের চোখের তারায়, চেহারার গাম্ভীর্যে, আর কথার গভীরতায় সেই অভিব্যক্তি ধরা পড়ে। বন্দিদশার পর, নতুন করে জীবনকে ছুঁয়ে দেখার বাসনায় তিনি গেলেন পবিত্র ওমরাহ পালন করতে। জীবনের সকল গ্লানি, সকল দুঃখ আর ক্লান্তি যেন মক্কা-মদিনার পবিত্র বাতাসে ধুয়ে ফেলতে চাইলেন তিনি।
ওমরাহ শেষে যখন জেদ্দার শহরে এলেন, তখনই দেখা হলো বহুদিনের পুরনো বন্ধু জমিরের সঙ্গে। সৌদি আরবের প্রবাসজীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা জমির এখন অনেক ব্যস্ত মানুষ, কিন্তু বন্ধুত্বের ডাক উপেক্ষা করা তার স্বভাব নয়। পুরনো বন্ধুর জন্য হৃদয় উজাড় করে দেওয়া, আতিথেয়তার উষ্ণতা ছড়িয়ে দেওয়া—এ যেন জমিরের সহজাত প্রবৃত্তি।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, জমিরের আমন্ত্রণে নাছির ভাইসহ আরও কয়েকজন মিলে বসে আছেন একসঙ্গে। রাস্তার পাশে লাল কার্পেট পেতে, হাতে চায়ের কাপ আর আশেপাশে রাখা পানির বোতল—এ যেন প্রবাসী জীবনের মাঝে এক টুকরো বাংলাদেশ। আলোচনার বিষয়বস্তু অবশ্যই পুরনো দিনের স্মৃতি, কারাগারের নির্মমতা, জীবনসংগ্রাম, এবং ভবিষ্যতের নতুন দিগন্ত। নাছির ভাইয়ের মুখে তখন হয়তো তৃপ্তির হাসি, হয়তো দুঃখবোধও, তবে নিশ্চিতভাবেই এটি এক নতুন শুরুর গল্প।
নাছির ভাইয়ের বসার ভঙ্গি আর চোখের দৃষ্টিতে একধরনের আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। মনে হয়, সৌদির এই ব্যস্ত শহরেও তিনি যেন ‘শেঠ’। সত্যিই, শেঠ যেখানেই যান, সেখানেই তার ব্যক্তিত্বের আলো ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ বছরের নিঃসঙ্গতার পরেও জীবনের প্রতি তার এই আস্থা, বন্ধুত্বের প্রতি ভালোবাসা—এটাই তাকে সত্যিকারের মহৎ করে তুলেছে।
অন্যদিকে, জমির এক পরিপূর্ণ বন্ধু। যে-ই বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যান, তিনি তাদের পাশে দাঁড়ান, মেহমানদারির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। আমি নিজেও তার এই আন্তরিকতার সাক্ষী। ২০১১ সালে হজব্রত পালনের সময় আমি ছিলাম জমিরের অতিথি, আর তখনই বুঝেছিলাম, তার বন্ধুত্ব কতটা আন্তরিক, কতটা উষ্ণ।
আজকের এই ছবি কেবল একটি মুহূর্ত নয়, এটি একটি ইতিহাসের দলিল। এটি জীবনের উত্থান-পতনের সাক্ষ্য, বন্ধুত্বের এক অসাধারণ নিদর্শন। নাছির ভাই কারাগারের অন্ধকার কাটিয়ে নতুন জীবনের পথে পা বাড়িয়েছেন, আর সেই যাত্রায় তার পাশে আছেন প্রিয় বন্ধুরা। সময়ের স্রোতে অনেক কিছু বদলায়, কিন্তু সত্যিকারের বন্ধুত্ব চিরন্তন, অমলিন।
জেদ্দার এক বিকেলে এই লাল কার্পেটের ওপর বসে থাকা মানুষগুলো আমাদের শিখিয়ে দিলেন—সংগ্রামের পর মুক্তি আসে, বন্ধুত্ব কখনো পুরোনো হয় না, আর শেঠ কখনো হারায় না তার ঐশ্বর্য, সে যেখানেই থাকুক না কেন!