নাইমা সুলতানার জীবনযাত্রা একটি অমলিন অধ্যায়। ছোট্ট একটি বাচ্চার মন, একের পর এক কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চড়ে ওঠে, লক্ষ্য পূরণের গল্পটাই অন্যরকম হয়ে ওঠে। তার জীবনটি একদিকে যেমন কঠিন সংগ্রাম, তেমনি অপর দিকে অজেয় সাহস ও ত্যাগের গল্প। মায়ের হাত ধরে বেঁচে থাকা, নিজের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম জয়ের মাধ্যমে একসময় তিনি আজ সফল পুলিশ অফিসার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
নাইমা সুলতানার জন্ম কুষ্টিয়া জেলার এক গ্রামে। যখন তার বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বছর, তখন তার প্রিয়জন বাবা সবার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন। বাবা না থাকায় মা একাই তাদের সংসার সামলাতেন, একদম একা। তিন বোন এবং এক ভাই—সবাই মায়ের কাছে আশ্রয় খুঁজে পেতেন। মায়ের এই অবর্ণনীয় কষ্ট এবং পরিশ্রমের প্রতিচ্ছবি তার জীবনে নানা সময়ে ফুটে উঠেছে। বাবা হারানোর যন্ত্রণা সে কীভাবে বুকে চেপে রেখেছিল, সে সত্যিই খুব কঠিন ছিল। কিন্তু সে কষ্ট তার আত্মবিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করেছে। যে বয়সে বাবা-মায়ের স্নেহ ও আদর পাওয়ার কথা, সে বয়সে সে অকালেই বাবাকে হারিয়ে জীবনযুদ্ধে প্রবেশ করেছিল। মায়ের সাহসিকতা, জীবন সংগ্রাম ও পরিবারের প্রতি তার অদম্য ভালোবাসা থেকেই নাইমা সুলতানা নিজেকে একটি শক্তিশালী চরিত্রে তৈরি করেছেন। ছোটবেলায় তিনি তার মায়ের প্রতিটি পদক্ষেপের মাঝে এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করতেন। সেই শক্তি তাকে তার জীবনযাত্রায় প্রতিটি সিঁড়ি উঠতে সাহায্য করেছে।
তবে, মায়ের অসীম সাহস এবং ভালোবাসার সঙ্গে, মীরপুরের সন্ত্রাসী এলাকাগুলোতে থাকা এক দল বখাটে ছেলেদের আচরণ তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। মায়ের অসহায়ত্ব এবং পুলিশের নীরবতার মধ্যে, নাইমা সুলতানা নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—যদি কখনো পুলিশ হন, তিনি ওইসব বখাটে ছেলেদেরকে শাস্তি দেবেন এবং পুলিশের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠবেন। ছোটবেলার এই দৃশ্যগুলোই তাকে ভবিষ্যতে পুলিশের আদর্শে দাঁড়ানোর জন্য প্রেরণা দিয়েছিল।
নাইমা সুলতানা যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে, তখন তাকে পেশা হিসেবে পুলিশ হওয়ার কথা মনে আসে। সেই সময় তার মনে হয়েছিল, এই যাত্রা তাকে এক নতুন পরিচয়ে উপস্থাপন করবে, যেখানে সে শুধু মানুষের সেবা করবে না, নিজের বিশ্বাসের শক্তিও প্রকাশিত হবে। তবে, তার এই সংগ্রামের পথ যে এতটা কঠিন হবে, তা হয়তো তখন তিনি জানতেন না। কিন্তু অবশেষে একদিন তিনি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ হয়ে ওঠেন।
তার কঠোর পরিশ্রম এবং জীবনযুদ্ধের ফলেই আজ তিনি পুলিশ সুপার (এসপি) পদে অধিষ্ঠিত। তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। নারীদের প্রতি সম্মান এবং তাদের আরও এগিয়ে আসার কথাও তিনি অনেক সময় বলেন। তার নিজের জীবনই তার জন্য প্রেরণা। অবশ্য, তার সফলতার পেছনে তার পরিবার, বিশেষত তার মা, যিনি এত কষ্টে বড় করেছেন, তাদের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। মা ছাড়া আজকের নাইমা সুলতানা এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতেন না। গত ১৭ই ফেব্রুয়ারী তাঁর অফিসে গিয়ে সরাসরি সাক্ষাৎ করে – আমার লেখা এইবারের একুশে বইমেলায় আবির প্রকাশন থেকে প্রকাশিত “সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কথা ” বইটি আমি যখন তার হাতে উপহার হিসেবে তুলে
দিলাম, তখন তিনি খুব আগ্রহের সঙ্গে বইটি গ্রহণ করেন। তার মুখে কিছুটা আবেগের ছোঁয়া ছিল, যখন তিনি বললেন, “বই পড়ার সময় এখন নেই, তবে আমি চেষ্টা করবো আপনার বইটি পড়তে।” এই কথা তার প্রতিশ্রুতি ছিল, তার জীবনের উদ্দেশ্য ও মানবিকতা থেকেই তিনি নিজের সময় বের করে, অন্যদের ভালোবাসতে চান।
সেই ছোটবেলার মীরপুরের পুলিশকে যেভাবে কখনও সহ্য করতে পারতেন না, আজ তিনি নিজেই পুলিশ হয়ে সেই পুরোনো সন্ত্রাসীদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।সেই মীরপুরের কথা- মীরপুরের এক সাধারণ এলাকায় যেখানে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও শান্তি মাঝে মাঝে হারিয়ে যেত সন্ত্রাসী কার্যকলাপের গুমোট আচ্ছাদনে, সেখানেই জন্ম নিল এক স্বপ্নদর্শী মেয়ে—নাইমা সুলতানা। তার শৈশবের স্মৃতি গুলো যেন এক আশাবাদী গল্পের মতো, যেখানে অন্ধকারেও আলো খোঁজার এক দৃঢ় সংকল্প ছিল। ছোট্ট বয়সে বাবার ছায়া হারিয়ে, যেখানে সংসারের দায়িত্ব তার মায়ের ওপর চাপিয়েছিল, সেখানে সেই মেয়ে একদিন নিজের জীবনযুদ্ধের এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে চেয়েছিল। নাইমা সুলতানা—একটি নাম, যা আজ দেশের সেরা পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি জায়গা করে নিয়েছে।
ছোটবেলার সংগ্রাম ও স্বপ্নের জন্মঃ
মীরপুরের একটি ছোট্ট বাড়ির চত্বরে তিন বোন, এক ভাই আর তাদের মায়ের সাথে কাটানো দিনগুলো ছিল একদিকে মধুর, অন্যদিকে দুঃখময়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে যখন তার বাবা পৃথিবী থেকে চলে যান, তখন সে বুঝতে পেরেছিল, জীবন তার জন্য তেমন সহজ হতে চলেছে না। তার মা এককভাবে তাদের তিন বোন, এক ভাইকে বড় করতে থাকেন, এবং মায়ের আদর্শে বেড়ে উঠতে থাকে নাইমা। কিন্তু মায়ের সংগ্রামী জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায় তাকে যেন এক নতুন প্রেরণা দিয়েছিল।
গল্পের সেই দুঃখী সময়গুলো নাইমার মনে এক দারুণ পরিবর্তন এনেছিল—মায়ের সান্নিধ্যে, একা একা দুর্বিপাককে সহ্য করতে করতে তাকে একদিন নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে হয়। তার চোখে, তার মনে, এক রোমান্টিক স্বপ্ন জমেছিল—একদিন সে পুলিশ হবে। তার মনের কোণে এক প্রতিজ্ঞা গেঁথে গিয়েছিল, “যদি কখনো পুলিশ হই, তবে দেশটাকে বদলে দেব।”
পুলিশ হওয়ার স্বপ্নে প্রবাহিত জীবনঃ
যখন সে মীরপুরের অলিতে গলিতে, যেখানে সন্ত্রাসীরা নির্লজ্জভাবে রাজত্ব করতো, সেখানকার শান্তি নষ্টকারী বকাটে ছেলেরা যখন তাদের জানালার গ্লাস ভেঙে দিতো, তখন তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেত—“কেন পুলিশ এগিয়ে আসেনি? কেন তারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি?” তবে সে জানতো, যে পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, একদিন আমি তাদের পরিবর্তন করবো।
নাইমার মনে ছিল দৃঢ় বিশ্বাস—একদিন সে পুলিশ হবে এবং ঐ সমস্ত সন্ত্রাসীদের শাস্তি দিবে, যাদের দ্বারা তারা নিজেকে কখনো নিরাপদ বোধ করতে পারেনি। এভাবেই সে নিজেকে তৈরি করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং সফলভাবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়। কিন্তু সে জানতো, এটি কোনো স্বপ্নের গল্প নয়; এটি ছিল জীবনের এক কঠিন বাস্তবতা, যা স্নেহের, সাহসের, কঠোরতার সঙ্গম ছিল।
একজন সফল নারী পুলিশ অফিসারের জন্মঃ
আজকের দিনে, যখন তাকে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো এর এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়, তার মুখের হাসি এক চিরস্থায়ী শান্তির প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এই হাসি শুধু তাঁর নয়, তার মায়ের, তার পরিবারের, এবং সেই সব নারীদেরও—যারা বিশ্বাস করে, জীবনের কঠিন সময়ে হার মানা উচিত নয়।
নাইমা সুলতানার জীবনের এই রোমান্টিক যাত্রা ছিল শুধুমাত্র তার এক স্বপ্ন পূরণের কথা নয়; এটি ছিল সেই সকল নারী, যারা তাদের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে, যারা পুলিশ হয়ে শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন নয়, নিজেদের আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ দিতে চায়।পুরানো দিনের সঙ্কল্পঃ আজ যখন তিনি নিজের মেধা এবং দক্ষতা দিয়ে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো তে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, তখন সে একদিনের শৈশবের স্বপ্নের কথা মনে করে। তখন মীরপুরের সন্ত্রাসী এলাকা ছিল তার জীবনের প্রেরণা—সে জানতো, একদিন তার হাতে সেই প্রতিশোধের হাতিয়ার হবে—পুলিশের ইউনিফর্ম। আজ সে নিজের কাজের মাধ্যমে সে প্রতিশোধের স্বাদ পেয়েছে।
সে নিজেকে কখনো কোনো অন্যায় সহ্য করতে দেয়নি, একে একে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি আজ এই উচ্চতায় পৌঁছেছেন। পুলিশের প্রতি তার ভালবাসা, মানুষের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি তাকে দেশব্যাপী পুরস্কৃত করেছে। চট্টগ্রাম মেট্রোতে পিবিআইয়ের সফল তদন্তের জন্য তাকে উচ্চ প্রশংসা করা হয়।
সফলতার সাথে নারীর আত্মবিশ্বাসঃ
নাইমা সুলতানার জীবনযাত্রা নিঃসন্দেহে একটি রোমান্টিক গল্প, তবে এটি শুধুমাত্র ভাবনার জগত নয়, বাস্তবের সত্যি রূপ। তার প্রতি সকল নারীদের উজ্জীবিত হওয়ার আহ্বান—আপনারা নিজেদের সামর্থ্য জানুন, সংগ্রাম করুন, এবং সব প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করুন।
তিনি বলেছিলেন, “নারীরা যদি নিজেদের লক্ষ্য ঠিক করে, তবে তারা পৃথিবী বদলে দিতে পারে।” তার এই বক্তব্য শুধুমাত্র নারীদের এক উদাহরণ নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।শেষ কথা: এক নতুন দিগন্তের দিকেঃ
নাইমা সুলতানা, আজকের সাহসী নারী পুলিশ কর্মকর্তা, শুধু একজন সফল পুলিশ নয়, তিনি একজন পরিশ্রমী, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এবং সমাজের এক প্রেরণাদায়ী ব্যক্তি। তার সংগ্রামী জীবন, তার সাহস, তার দৃঢ়তা—এইসবই তাকে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
নাইমা সুলতানার পথচলা একটি রোমান্টিক গল্পের মতো, যেখানে সংগ্রাম, সাফল্য, ও মনের জয়ের একটা অনবদ্য মিলন ঘটেছে। তার জীবন যেন এক চিরকালীন বার্তা, যেখানে প্রতিটি নারী নিজেদের রূপান্তরিত করতে পারে, শুধু তাদের সংগ্রামের মাঝ দিয়ে। নাইমা সুলতানা আজ আমাদের সকলের কাছে এক শক্তিশালী মডেল, যে নারী শুধুমাত্র নিজের জীবনকেই জয় করেননি, বরং তিনি পৃথিবীটাকে বদলানোর পথে অগ্রসর হচ্ছেন।