শরতের নরম বাতাসে ভোরের প্রথম আলো যখন ধীরে ধীরে সাগরের বুকে বিস্তার লাভ করছে, তখন আমি পা ফেললাম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বালুকাবেলায়। দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটার ইচ্ছে নিয়েই নেমেছিলাম, কিন্তু সাগরের বিশালতা, ঢেউয়ের অনন্ত গান, আর নির্জন সৈকতের গভীর আহ্বান আমায় এতটাই মোহিত করল যে সময়ের হিসেব ভুলে গেলাম।
গতরাতে চাটগাঁইয়া নওজোয়ানের আয়োজনে সময় কেটেছে দারুণ আনন্দে। আড্ডা, হাসি, গান আর স্মৃতিচারণায় ডুবে থেকে কখন যে রাত গভীর হয়েছে, তা টের পাইনি। সেই আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই কক্সবাজারের সমুদ্র আমাকে নতুন করে এক অন্য রকম আনন্দ দিল। রাতের উদ্দীপনার পর ভোরের সমুদ্রের প্রশান্তি যেন এক অপূর্ব বিপরীত অনুভূতি—একদিকে উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে নীরব সৌন্দর্য।
আমি হাঁটতে ভালোবাসি। চট্টগ্রামের ডিসি হিল, যেখানে শালবন আর পুরনো বৃক্ষের ছায়ায় কতদিন সকালটা শুরু হয়েছে! বাটালি হিলের শতায়ু অঙ্গনের পথে হাঁটতে হাঁটতে কতবার মনে হয়েছে, মানুষের শরীর আর মন প্রকৃতির কাছেই প্রশান্তি খোঁজে। ঢাকার রমনা পার্ক কিংবা ধানমন্ডি লেকের পথে হাঁটার অভিজ্ঞতাও আছে আমার, কিন্তু আজকের এই সকাল, এই হাঁটা—সবকিছুকে ছাপিয়ে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি এনে দিল। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন এক বিশাল সুরেলা তান, যা একটানা বাজছে অবিরাম। সাদা ফেনায় আছড়ে পড়া জলরাশি যখন বালুর গায়ে এসে মিশে যায়, তখন মনে হয় প্রকৃতি নিজেই এক চিত্রশিল্পী, যে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন রঙে এঁকে দিচ্ছে সৈকতের ছবি। এই ঢেউয়ের গর্জন শুধু শব্দ নয়, যেন এক পুরনো কাব্যের আবৃত্তি, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই অনন্ত নীল সমুদ্রের বুকে।
সাগরের বাতাস শরীরে এসে লেগে মনে করিয়ে দিল, এ বাতাস কেবল বাতাস নয়, এ যেন মুক্তির স্পর্শ। হাজারো চিন্তা, ব্যস্ততা, শহরের ধুলোবালি আর ক্লান্তি সব উড়িয়ে দিয়ে এক নতুন প্রশান্তির বার্তা নিয়ে আসে এই সমুদ্রের হাওয়া। আমি চোখ বন্ধ করলাম, গভীর করে নিঃশ্বাস নিলাম, যেন এই বিশুদ্ধ বাতাস আমার সমস্ত অস্তিত্বকে ভরে দিক।
সামনে তাকিয়ে দেখি, গাংচিলগুলো দল বেঁধে উড়ছে। কখনো সাগরের পানির ঠিক ওপরে ঝাপটা দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, কখনো আবার ঢেউয়ের ধাক্কায় ডানা গুটিয়ে বসে থাকছে বালুকাবেলায়। তাদের এই স্বাধীন উড়াল যেন আমাকেও ডেকে বলছে— “তুমিও উড়ো, নিজের ভাবনার সীমানা ছাড়িয়ে নতুন কিছু আবিষ্কার করো!”
সৈকতের বালুর ওপর ঝিনুক আর শামুকের খোলস ছড়িয়ে আছে, যেন সমুদ্রের ছুঁড়ে দেওয়া উপহার। এগুলোর মধ্যে কত শত গল্প লুকিয়ে আছে, কত ঢেউয়ের ছোঁয়া পেয়েছে তারা, তা কে জানে? আমি কয়েকটি তুলে নিলাম, হাতের তালুতে রেখে অনুভব করলাম সাগরের এক টুকরো ইতিহাস।
পেছনে তাকিয়ে দেখি, পর্যটকরা নেমে পড়েছে সৈকতে। কেউ পা ভিজিয়ে হাঁটছে, কেউ পানিতে দাপাদাপি করছে, আবার কেউ সাগরের শান্ত নীল জলে এক মনে ডুবিয়ে রেখেছে দৃষ্টি। শিশুদের উচ্ছ্বাস, তরুণ-তরুণীদের কোলাহল, বয়স্কদের নিরব প্রশান্তি—এই সমুদ্র যেন সকল বয়সের মানুষের জন্য এক আশ্রয়।
আমি হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করলাম, সমুদ্রের ধারের এই মুহূর্তগুলো কেবল বিনোদন নয়, এটি আত্মার এক গভীর বিশ্রাম। দিনের পর দিন কাজের চাপে, শহরের ব্যস্ততার মাঝে আমরা ভুলে যাই প্রকৃতি কতটা আপন। কিন্তু এই সাগর, তার ঢেউ, তার বিশুদ্ধ বাতাস—এসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির কোলে ফিরলেই প্রকৃত প্রশান্তি মেলে।
হাঁটতে হাঁটতে আমি নিজেকেও যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। কক্সবাজারের এই নিরব-শব্দহীন হাঁটা যেন আমার সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিয়ে এক নতুন সঞ্জীবনী শক্তি এনে দিল। মনে হলো, বহু বছর ধরে জমে থাকা ক্লান্তির কুয়াশা কেটে গিয়ে নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে আমার ভেতর।
এই সমুদ্র শুধু পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত নয়, এটি এক অনুভূতির নাম, এক ভালোবাসার নাম। এটি মুক্তির নাম, প্রশান্তির নাম। এখানে এলে মনে হয়, প্রকৃতির এই বিশালতার মাঝে আমরা কত ক্ষুদ্র, কিন্তু সেই ক্ষুদ্রতার মাঝেই লুকিয়ে আছে এক অনন্ত সৌন্দর্য।
সেই সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেয়েই হয়তো আমি আজ এত আনন্দিত, এত মুক্ত, এত প্রশান্ত!