জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনা যেন এক নতুন ভোরের আভাস। সূর্যের প্রথম কিরণ যেমন ধরণীর অন্ধকার সরিয়ে আলোকিত করে, তেমনই “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” নামটি হৃদয়ের অন্ধকার দুর করে শান্তি ও কল্যাণের আলো ছড়িয়ে দেয়। ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিদিনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজ, সবকিছুর প্রারম্ভেই এই পবিত্র বাক্য উচ্চারণের বিধান রয়েছে। “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” – অর্থাৎ পরম করুণাময়, দয়ালু আল্লাহর নামে। এই বাক্যটি শুধু একগুচ্ছ শব্দ নয়, বরং এক মহাবিশ্বের রহস্য যা বহু যুগ ধরে জ্ঞানী-গুণী, সাধক এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় হয়ে রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া হয় না, তা বরকতহীন হয়ে পড়ে।” অর্থাৎ, বিসমিল্লাহর মাধ্যমে যে কাজ শুরু করা হয়, তাতে আল্লাহর রহমত ও বরকত নেমে আসে। বিসমিল্লাহ: এক গাণিতিক অলৌকিকতা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বাক্যটি ১৯টি অক্ষরে গঠিত। এই ১৯ সংখ্যা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তার উপর উনিশ জন নিযুক্ত রয়েছে” (সূরা মুদ্দাসসির, আয়াত ৩০)। আল্লাহর প্রত্যেক সৃষ্টি এবং কর্মের মধ্যে নিপুণ এক সমতা রয়েছে। বিসমিল্লাহর ১৯ সংখ্যার অলৌকিক বিন্যাস এক বিস্ময়কর অধ্যায়।
বিসমিল্লাহ বাক্যের ৪টি শব্দ ও তাদের সংখ্যা:
১. বিসমি – এই শব্দটি কোরআনে ১৩৩ বার এসেছে, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য।
২. আল্লাহ – পবিত্র কোরআনে ২৬৯৮ বার উল্লেখিত, এটি ১৯ দ্বারা বিভাজ্য।
৩. রহমান – ৫৭ বার এসেছে, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য।
৪. রাহিম – ১১৪ বার এসেছে, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য।
এ যেন এক মহাজাগতিক বিন্যাস। কেউ কেউ বলেন, এই সংখ্যা ১৯ এক মৌলিক সংখ্যা যা আল্লাহর একত্ব ও মহিমার প্রতীক। ১ ও ৯ – এই দুটি অংকের যোগফল ১০, যা পুনরায় ১+০=১। আর আল্লাহ তো এক, একমাত্র সৃষ্টিকর্তা।
ইতিহাসের পাতায় বিসমিল্লাহর প্রভাব হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত সমস্ত নবী-রাসুলগণ তাদের জীবনের প্রতিটি কাজে বিসমিল্লাহ উচ্চারণ করতেন। কোরআনে সূরা নমলের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“সোলায়মান থেকে, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।”
এতে বোঝা যায়, নবী সোলায়মান (আঃ) ও তার রাজত্বেও বিসমিল্লাহর বিশেষ গুরুত্ব ছিল।
দুনিয়ার প্রথম লিখিত শব্দ
পবিত্র কোরআনের একটি হাদিসে বলা হয়, যখন আল্লাহ লাওহে মাহফুজ (সংরক্ষিত ফলক) এবং কলম সৃষ্টি করলেন, তখন কলমকে আদেশ দিলেন লিখতে। কলম সর্বপ্রথম যা লিখল, তা হলো – “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”। এই বাক্যই দুনিয়ার প্রথম লিখিত শব্দ। বিসমিল্লাহর আধ্যাত্মিক শক্তি
বিসমিল্লাহ পাঠের মাধ্যমে মানুষ আত্মিক শান্তি অনুভব করে। এটি শুধু কল্যাণকর বাক্য নয়, বরং আত্মরক্ষার ঢাল। ইসলামের মহামনীষীরা বলেন, “যে ব্যক্তি দিনে ১০০ বার বিসমিল্লাহ পড়ে, তার সমস্ত অশুভ শক্তি দূর হয়ে যায় এবং সে বিপদ থেকে মুক্ত থাকে।” ইমাম গাজ্জালী (রঃ) বলেছেন –
“যদি কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সফলতা লাভ করতে চায়, তবে সে যেন ১০০০ বার বিসমিল্লাহ পড়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে। এরপর আল্লাহর দরবারে নিজের বাসনার জন্য মুনাজাত করে।” দুনিয়ার এবং আখেরাতের বরকত
বিসমিল্লাহ শুধু পার্থিব জীবনের নয়, বরং আখেরাতেরও অন্যতম এক আশ্রয়। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন যখন বান্দার আমলনামা উপস্থাপন করা হবে, তখন তার আমলসমূহের পাল্লা হালকা হতে থাকবে। কিন্তু যখন বিসমিল্লাহ লেখা কাগজটি রাখা হবে, তখন তা এত ভারী হয়ে যাবে যে, সমস্ত পাপ মাফ হয়ে যাবে।”
সূরা ফাতেহার শোভা পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরা, সূরা ফাতেহার শুরুতেই রয়েছে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”। এই সূরাকে বলা হয় “উম্মুল কোরআন” অর্থাৎ, কোরআনের মা। আর বিসমিল্লাহ হলো সেই মুকুটের রত্ন। দৈনন্দিন জীবনে বিসমিল্লাহর ব্যবহার খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ পড়লে খাবারে বরকত হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বিসমিল্লাহ পড়লে আল্লাহর হেফাজত লাভ হয়।
ঘুমানোর আগে বিসমিল্লাহ পড়লে রাতের সকল বিপদ থেকে মুক্তি মেলে। সন্তান জন্মের পর কানে আজান দেয়ার আগে বিসমিল্লাহ উচ্চারণ করা সুন্নত। “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” শুধু একটি বাক্য নয়, এটি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গী। বিপদের সময়, ক্লান্তির সময়, এমনকি আনন্দের সময়ও এই বাক্য আল্লাহর রহমত ও শান্তির বার্তা নিয়ে আসে। এই পবিত্র বাক্যের মহাত্ম্য, তাৎপর্য এবং অলৌকিক রহস্য যুগ যুগ ধরে মানুষকে আল্লাহর প্রতি আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করেছে।
আমাদের করণীয় প্রতিদিনের জীবনে বিসমিল্লাহকে অন্তর্ভুক্ত করা, সকল কাজে আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করা, এবং আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা। “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” – এই বাক্য আমাদের জীবনের পথে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকুক।
লেখকঃ শিক্ষানবীশ সাংবাদিক, সাবেক সিটি কপোরেশন এর কর্মকর্তা।