শ্রাবন্তী তুমি মমতার প্রতিমা,বাবার চোখে জ্বালাও জীবনের দীপা। তোমার ত্যাগে ফুটে উঠে সুরের ভাষা,জীবনের গান হয়ে যায় ভালোবাসা।
“তুমি অনন্য, তুমি আলোর প্রদীপ,
ত্যাগের গল্পে ভরাও হৃদয়, তৃষিত।
সমাজের বুকে তুমি এক উজ্জ্বল নাম,
শ্রাবন্তী তুমি ভালোবাসার সম্মান।”
বাবার প্রতি শ্রাবন্তীর ত্যাগ ও ভালোবাসার গল্পটি লিখতে বসছি বিবেকের তাগিদে, শ্রাবন্তী শুক্লা—এক অসামান্য প্রতিভাবান শিল্পী। গানের জগতে তার নামডাক কম নয়। সুরের মাধুর্যে সে দর্শকের মন ভরিয়ে দেয়, হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে এক অনাবিল অনুভূতি। তবে তার জীবনের গল্পটা অন্য রকম। গানের মঞ্চ থেকে বাস্তব জীবনে সে যেন এক অনন্য দৃঢ়তার প্রতিমূর্তি।
শ্রাবন্তীর বাবা ছিলেন রেলওয়ের একাউন্টস বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তার কর্মময় জীবন অবসরে পৌঁছানোর কিছুদিন পরেই হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক করেন। সেই স্ট্রোক তার জীবন পুরোপুরি বদলে দেয়। একসময়ের দৃঢ় এবং কর্মঠ মানুষটি হয়ে পড়েন মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। বাবার এই দুর্বল অবস্থায় পরিবারের কেউ যখন তার তেমন যত্ন নিতে পারছিল না, তখন এগিয়ে আসে শ্রাবন্তী। তার বাবাকে এখন এক শিশুর মতো করে খাওয়াতে হয়, যত্ন করতে হয়। কখন কী করবেন, কীভাবে করবেন, তার কোনো ঠিক নেই। কখনো খাবার ছড়িয়ে দেন, কখনো অযাচিত জায়গায় টয়লেট করে ফেলেন। এমনকি কখনো আচরণও হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রণহীন। কিন্তু এই মানুষটিকেই শ্রাবন্তী হৃদয়ের গভীর মমতায় আগলে রেখেছে। বাবার প্রতি তার স্নেহ এমন যে কোনো কঠিন মুহূর্তেও তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে না।
শ্রাবন্তীর মা-ও বৃদ্ধা। বয়সের ভারে তার পক্ষে স্বামীকে পূর্ণ সময় দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভাইয়েরা সবাই নিজেদের কাজে এতটাই ব্যস্ত যে বাবার দেখভালের জন্য তাদের সময় মেলে না। পুরো পরিবারটির ভার যেন একাই বহন করছে শ্রাবন্তী।
কিন্তু এ ত্যাগের জন্য কোনো অভিযোগ নেই তার। বাবার প্রতি ভালোবাসার টানে সে তার স্বপ্নের অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়েছে। একসময় গানের মঞ্চে নিয়মিত থাকলেও এখন সে অনুষ্ঠানে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। বাবাকে একা রেখে দূরে কোথাও গেলেই তার মন পড়ে থাকে ঘরের কোণে। বাবার জন্য সে তার ব্যক্তিগত জীবন, এমনকি বিয়ের কথাও ভাবেনি। এই সমাজে যেখানে অনেক সন্তান বাবা-মাকে অবহেলা করে, তাদের দেখভাল তো দূরের কথা, বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে—সেই সমাজেই শ্রাবন্তী এক উজ্জ্বল উদাহরণ। বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যে কতটা গভীর হতে পারে, শ্রাবন্তীর জীবন সেই শিক্ষা দেয়। তবু শ্রাবন্তীর মনে কোনো হতাশা নেই। তার গান, তার সুর, তার সৃষ্টিশীলতাই যেন বাবার প্রতি তার ত্যাগকে পূর্ণতা দেয়। বাবার যত্নে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেই সে খুঁজে নিয়েছে জীবনের প্রকৃত অর্থ।
শ্রাবন্তীর আরাধনা
শ্রাবন্তী শুক্লার জীবন যেন এক অসীম আরাধনার গল্প। গান তার সাধনা, সুর তার নিঃশ্বাস। দীর্ঘদিন ধরে সে তার গানের মান উন্নত করার জন্য নিবিড় অনুশীলনে ডুবে রয়েছে। চট্টগ্রামের অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সে যুক্ত, বিশেষ করে শিল্পী সমিতি ও চাটগাঁইয়া নওজোয়ানের সাথে তার সক্রিয় সম্পৃক্ততা তাকে সবার কাছে পরিচিত মুখ করে তুলেছে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে শ্রাবন্তীর গান যেন নতুন এক রঙ ছড়ায়। তার গান শুনে মন ভরে গেছে বহুবার, আর সেখান থেকেই আমার সঙ্গে তার সখ্যতা।
শ্রাবন্তী একজন সাদামনের মেয়ে। নাটকীয় আচার-আচরণ, ভাঁড়ামি—এসব তার স্বভাবের সঙ্গে যায় না। জীবনের পথে সে প্রেমে পড়েছিল একবার। কিন্তু সেই প্রেমিকের মন-মানসিকতার সঙ্গে তার মনের মিল হয়নি। তাই সে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তার কথা স্পষ্ট—”যে প্রেম করব, তার সঙ্গে সংসার করার মন নিয়ে করব। সস্তা অভিনয়মুখী প্রেম আমার জন্য নয়।” বিয়ের প্রসঙ্গে শ্রাবন্তীর শর্ত একটাই—যে-ই তাকে বিয়ে করবে, তাকে তার বাবাকে সেবা করার সুযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনে সে তার গান, এমনকি স্বামীর ঘর ছেড়ে আসতে পারে, কিন্তু অসুস্থ বাবাকে ছেড়ে কখনোই নয়। তার বাবার প্রতি এই অসীম ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ তাকে এই সমাজের মেয়েদের ভিড়ে আলাদা করেছে। তার সঙ্গে আমার বহুবার খোলামেলা কথা হয়েছে। সে তার ভয়, তার দুঃশ্চিন্তা নিয়ে কথা বলেছে। তার বাবা একসময় সুস্থ ছিলেন, কিন্তু ব্রেন স্ট্রোকের পর থেকে পুরোপুরি অন্য রকম হয়ে গেছেন। এখন তিনি প্রায় প্রতিবন্ধীর মতো, নিজের প্রয়োজন বা কষ্টের কথাও স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। শ্রাবন্তীর মা ও ভাইয়েরা বাবার যত্নে তেমন মনোযোগী নন। তার ভাইরা এখনো বিয়ে করেনি, কিন্তু বিয়ে করলে তাদের স্ত্রীরা কি বাবার প্রতি সেই সেবা-যত্ন দেখাবে? এই প্রশ্নই শ্রাবন্তীর মনে গভীর ভয় সৃষ্টি করে। শ্রাবন্তীর জীবন যেন তার বাবাকে ঘিরেই আবর্তিত। তার সোনালি যৌবন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে নিজেকে গানের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে, বাবার যত্নে নিঃস্বার্থভাবে উৎসর্গ করেছে। প্রেম, ভালোবাসা, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া—সব কিছুতেই বাবার উপস্থিতি তার মনে গাঁথা। সমাজে যেখানে অনেকেই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি অবহেলা দেখায়, সেখানে শ্রাবন্তীর মতো মেয়েরা এক অপূর্ব উদাহরণ। তার এই ত্যাগ, এই ভালোবাসা শুধু তার বাবার জন্য নয়, আমাদের পুরো সমাজের জন্য এক মহৎ অনুপ্রেরণা।
শ্রাবন্তী শুক্লার ভালোবাসা-
শ্রাবন্তী শুক্লা, এক প্রতিভাবান গানের শিল্পী, যিনি সুরের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বহু কষ্ট ও সাধনার পর। গানের প্রতি তার ভালোবাসা অদম্য, তবে তার ভালোবাসার প্রকৃত গভীরতা অন্য এক জায়গায়। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা তার বাবা, যিনি এখন অসুস্থ, চলতে-ফিরতে অক্ষম। শ্রাবন্তীর বাবা একসময় ছিলেন রেলওয়ে একাউন্ট্যান্ট। সুস্থ ও কর্মক্ষম অবস্থায় তিনি তার পরিবারকে যথাযথভাবে দেখাশোনা করতেন, কিন্তু আজ তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে। ব্রেনস্ট্রোকের পর তার জীবন হয়ে গেছে এক অন্ধকার মহল। এখন তিনি শয্যাশায়ী, ছোট বাচ্চার মতো হাত মুখ পরিষ্কার করতে হয়, খাবার খাওয়াতে হয়। কিন্তু শ্রাবন্তী, যিনি স্বপ্ন দেখতেন একদিন বিশ্বজুড়ে তার গানের নাম ছড়িয়ে যাবে, আজ নিজেকে তার বাবার সেবায় সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছেন।
দশ্রাবন্তীর নিজের একটি জীবনের ইচ্ছে ছিল—বিয়ে, সংসার, ভালোবাসা। কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসাধ্য লক্ষ্য ছিল বাবার সেবা। সে জানত, তার বাবার অবস্থা অনেকদিনের জন্য এমনই থাকবে, আর ভাই-বোনরা নিজের কাজে এতটাই ব্যস্ত যে, তাদের কাছে বাবার যত্ন নেওয়া সম্ভব নয়। মা-ও বয়সের কারণে আগের মতো সেবা করতে পারতেন না। ফলে, শ্রাবন্তী, যিনি এক সময় জীবনের অন্য পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন, সেই পথ ছেড়ে বাবার কাছে ফিরে আসেন। তবে শ্রাবন্তীর জীবন ছিল সহজ না। তার জীবনের স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্নের মধ্যে ছিল এক বিরাট ফারাক। সে জানত, বিয়ে করতে হলে তার শর্ত একটাই—”আমার বিয়ের পর যদি কোনো সংসারী জীবন বাঁচাতে হয়, তবে আমার বাবাকে সেবা করতে হবে। তার যত্নের দায়িত্ব মেনে চলতে হবে।” শ্রাবন্তী এক কথায় বলেছিল, “বাবাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না, তার সেবা করে আমার জীবনের ভালোবাসার সার্থকতা পূর্ণ হবে।”
এমনকি প্রেমের সম্পর্কেও তার স্পষ্ট ধারণা ছিল। একসময় তার প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে তার প্রেমিকের মানসিকতা তার সঙ্গে মেলে না, তখন সে নিজেকে সরিয়ে নিল। সে জানত, সংসার করতে হলে শুধু ভালোবাসা নয়, দুজনের একসঙ্গে চলার জন্য মানসিকতার মিলও থাকতে হয়। সে কখনোই সস্তা প্রেম বা খোলামেলা সম্পর্কের প্রতি আগ্রহী ছিল না।
আজ তার জীবনে এক বড় প্রশ্ন—যতদিন তার বাবা থাকবে, সে কি একা থাকতে পারবে? তার জীবন যেন তার বাবার ঘিরে আবর্তিত। নিজের ইচ্ছাগুলো সে একপাশে রেখে দিয়েছে, কারণ তার বাবার সেবা করা তার কাছে সবচেয়ে বড় কর্তব্য। তার পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য শ্রাবন্তী শুক্লা এমন এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। একটি সোনালী জীবন, যা অন্যদের মতো চমকপ্রদ নয়, কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে এক অমূল্য ত্যাগ ও ভালোবাসা—বাবার প্রতি সেই ভালোবাসা, যা কোনও সোনালী প্রাপ্তির চেয়ে অনেক মূল্যবান।শ্রাবন্তী শুক্লা আমাদের শেখালেন, যে প্রেম সবচেয়ে বড়, তা হলো পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, আর সে দায়িত্ব পালন করতেই সবচেয়ে বড় ভালোবাসা।