আকিজের গল্প শুনলে মনে হবে যেন তিনি কোনো যাদুকর, যার যাদুর কাঠিতে সোনা বয়ে আসত, আর তাঁর মধুর মায়ায় বাঁধা পড়েছিল দেশটির ব্যাংক জগতের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা। তাঁর ক্ষমতা আর প্রভাবের বিস্তার ছিল এতটাই গভীর যে, তিনি এককভাবে পুরো ব্যাংকিং খাতকে নিজের ইচ্ছার জালে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যাদুতে মোড়ানো আকিজের উত্থান আকিজের জীবনের গল্প যেন কোনো মধুময় রূপকথা। একজন সামান্য ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে তিনি হয়ে উঠলেন ব্যাংক জগতের অঘোষিত সম্রাট।
২০০৯ সালে এক অতি সাধারণ সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘যাদু’ এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠল যে, দেশটির ব্যাংকিং খাত তাঁর ইশারায় চলতে লাগল। তাঁর এই যাদুর মধ্যে লুকিয়ে ছিল ক্ষমতাসীনদের সঙ্গ, গভীর সখ্যতা, এবং আর্থিক খাতকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করার অসাধারণ দক্ষতা। যে যাদুতে মধু ছিল আকিজের ক্ষমতা এতটাই প্রবল ছিল যে, বাংলাদেশের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘স্যার’ বলে। সেই মধুর স্রোত বইয়ে নিয়ে আসতে তিনি নামিদামি কোম্পানির শেয়ার কিনতেন, বেনামি ঋণ তুলতেন, এবং হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করতেন। ব্যাংকের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আমলা, এমনকি রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই তাঁর যাদুর মধুতে আকৃষ্ট ছিলেন। শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতির সখ্যতা আকিজ উদ্দিনের ক্ষমতার অন্যতম বড় ভিত্তি ছিল তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ।
তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্যতা ছিল, যা তাঁকে অপরাধের পাহাড় গড়তে প্রণোদনা দিয়েছিল।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও ছিল ঘনিষ্ঠতা, যা তাঁর প্রভাবকে আরও দৃঢ় করেছিল। অঘোষিত ব্যাংক সম্রাট আকিজ উদ্দিনকে কেউ বলত ব্যাঙ্কিং খাতের অঘোষিত সম্রাট। তাঁর এক ইশারায় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত বদলে দিতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, যাঁর উচিত ছিল আর্থিক খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, তিনি নিজেই আকিজের নির্দেশনা অনুসরণ করতেন। রূপকথার নায়ক থেকে জাতির শত্রু আকিজের গল্প যতটা রূপকথার মতো মনে হয়, ততটাই ভয়ঙ্কর বাস্তব। তাঁর যাদুর মোড়কে ছিল লুটপাট, দুর্নীতি, এবং অর্থপাচারের গল্প। দেশের হাজার হাজার সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা তিনি বেনামি ঋণ, অবৈধ শেয়ার ক্রয়, এবং বিদেশে পাচার করে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর ক্ষমতা শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করেছিল। যাদুর অন্তিম অধ্যায় তাঁর যাদু শেষ হয়ে যায় যখন তাঁর অপকর্ম জনসম্মুখে আসে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিদ্রোহ, দুর্নীতির তদন্ত, এবং তাঁর ব্যাংক হিসাব জব্দের মধ্য দিয়ে আকিজের যাদুর গল্পের ইতি টানা হয়।
রূপকথার শিক্ষা আকিজের জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, অসৎ পথে পাওয়া ক্ষমতা ও সম্পদ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাঁর যাদু যদি দেশের জন্য সঠিকভাবে কাজে লাগানো যেত, তবে হয়তো তিনি ইতিহাসে মহানায়ক হিসেবে জায়গা করে নিতে পারতেন। কিন্তু আজ, তিনি জাতির শত্রু হিসেবে পরিচিত, যাঁর লোভ ও দুর্নীতি আমাদের অর্থনীতিকে চরম বিপদে ফেলেছে। এ যেন এক রূপকথার গল্প, যেখানে নায়কের পতনই গল্পের মূল শিক্ষা।
আকিজ উদ্দিন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক চরম বিতর্কিত নাম, যিনি এস আলম গ্রুপের ছত্রছায়ায় দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। তাঁর জীবনের উত্থান ও দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ দেশের জনগণের জন্য একটি শিক্ষা হতে পারে। নিচে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত ও অপরাধসমূহের বিশদ তুলে ধরা হলো। আকিজ উদ্দিনের জীবনবৃত্তান্ত জন্ম ও প্রাথমিক জীবন: আকিজ উদ্দিনের জন্ম বাংলাদেশের একটি গ্রামে, যেখানে তিনি সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জানা গেছে, চাকরির শুরুতে তিনি একজন সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন।
পেশাগত উত্থান:২০০৯ সালে আকিজ উদ্দিন এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে সহকারী কর্মকর্তা (ক্যাশ) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মাত্র ১৪ বছরের ব্যবধানে অস্বাভাবিক পদোন্নতি পেয়ে তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদে আসীন হন। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের প্রটোকল অফিসার (পিএস) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি গ্রুপের বিভিন্ন অপকর্মের মূল কারিগর হিসেবে পরিচিতি পান। অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড ব্যাংকিং দুর্নীতি: বেনামি ঋণ: আকিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি এস আলম গ্রুপের নামে ও বেনামে কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। ৮৮৯ কোটি টাকার বেনামি ঋণ উত্তোলনের চেষ্টার ঘটনা তাঁর অন্যতম বড় অপরাধ।
অবৈধ পদোন্নতি: এস আলম গ্রুপের নির্দেশে আকিজ তাঁর অবস্থান কাজে লাগিয়ে ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিক প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং অবৈধ নিয়োগ ও পদোন্নতি আদায় করেছেন।অর্থ পাচার: বিদেশে টাকা পাচার করে বিভিন্ন বেনামি কোম্পানি ও শেয়ার কেনার মাধ্যমে এস আলমের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর আমদানি-রপ্তানি ব্যবসাগুলো ছিল পাচারের মূল মাধ্যম।
ব্যক্তিগত দুর্নীতি:
আকিজ উদ্দিনের নামে এবং পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তাঁর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো—‘গোল্ডেন স্টার’ এবং ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’—ব্যাংক থেকে অবৈধ ঋণ নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এস আলমের অপরাধ সাম্রাজ্যের অংশীদার: এস আলম গ্রুপের নির্দেশে তিনি ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেনামি ঋণ সৃষ্টি ও অর্থ লুটের চক্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এস আলমের বিদেশি কোম্পানিগুলো থেকে শেয়ার কেনার মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ সরিয়ে নেওয়ার কাজেও তিনি জড়িত ছিলেন। জনগণের সর্বনাশ ও অর্থনীতির ক্ষতি আকিজ উদ্দিনের কর্মকাণ্ডে শুধু ব্যাংক নয়, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ফলে নিরীহ জনগণ আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে তাঁর দুর্নীতির ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধীর তকমা আকিজ উদ্দিনের অপরাধ সীমান্ত ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থ পাচার, বেনামি শেয়ার কেনা, এবং বিদেশে অপ্রকাশিত সম্পদের মালিক হওয়া তাঁকে আন্তর্জাতিক অপরাধীর কাতারে স্থান দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আকিজ উদ্দিন শুধু নিজে নয়, এস আলম গ্রুপের চক্রের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ব্যাংকের বৈধ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি আটকে রেখে অবৈধ নিয়োগের মাধ্যমে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছেন। শাস্তি ও ভবিষ্যৎ প্রতিরোধ আকিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, এবং তাঁর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তবে শুধু তদন্তই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। এস আলম গ্রুপ এবং আকিজ উদ্দিনের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দেশের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা।
আকিজ উদ্দিনের এই অপরাধ জগত দেশের জন্য একটি ভয়ানক শিক্ষা। দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাত রক্ষায় এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধী আকিজ উদ্দিন: এস আলম গ্রুপের ছায়ায় শত শত কোটি টাকা লুটপাটের নায়ক আকিজ উদ্দিন, যিনি একসময় এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের প্রটোকল অফিসার (পিএস) ছিলেন, আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অপরাধ জগতের এক কলঙ্কিত নাম। ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিক প্রভাব ও এস আলম গ্রুপের ছত্রছায়ায় দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করে তিনি অসংখ্য নিরীহ মানুষকে দেউলিয়া করার মূল কারিগর। ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং তদন্তের নির্দেশনা সম্প্রতি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) আকিজ উদ্দিন এবং তাঁর পরিবারের সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। তাঁদের ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব থেকে কোনো লেনদেন বন্ধ করা হয়েছে। বিএফআইইউয়ের তথ্য অনুসারে, ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৮৯ কোটি টাকার বেনামি ঋণ উত্তোলনের চেষ্টার অভিযোগে আকিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। পদোন্নতির নামে দুর্নীতির রথযাত্রা
২০০৯ সালে একজন সহকারী কর্মকর্তা (ক্যাশ) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে আকিজ মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদে আসীন হন। এই অস্বাভাবিক উত্থান ছিল এস আলম গ্রুপের অপকর্মের মূল শক্তি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি এস আলমের নির্দেশনায় হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো গোল্ডেন স্টার’ এবং ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’—ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে অবৈধ ঋণ উত্তোলন এবং বেনামি শেয়ার কেনার কাজে লিপ্ত ছিলেন। আর্থিক লুটপাট ও জনগণের সর্বনাশ ইসলামী ব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন নিয়ে বেনামি ঋণ সৃষ্টি, শেয়ার কেনাবেচা এবং বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে আকিজ উদ্দিন দেশের অর্থনীতিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তিনি শুধুমাত্র এস আলম গ্রুপের স্বার্থ রক্ষা করেননি, বরং দেশের অর্থনীতির শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছেন। সরকার পতনের পর বিক্ষোভ ও প্রভাবহীনতা গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, এস আলম গ্রুপের নির্দেশে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকারদের বিক্ষোভ শুরু হয়। ৬ আগস্ট আকিজ উদ্দিনসহ এস আলমের পৃষ্ঠপোষকতায় পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে, ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় আকিজ উদ্দিনের দুর্নীতির প্রমাণ নিয়ে কর্মকর্তারা সরব হন। আন্তর্জাতিক অপরাধীর উপাধি প্রাপ্য আকিজ উদ্দিন কেবল একজন দুর্নীতিবাজ নয়, বরং তিনি দেশের শত শত কোটি টাকা লুটপাট করে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে পথে বসানোর মূল হোতা। তিনি দেশের অর্থনীতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, যিনি এস আলম গ্রুপের ছায়ায় জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। এই অপরাধের মাত্রা এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের প্রেক্ষিতে তাঁকে আন্তর্জাতিক অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করা উচিত। দেশের অর্থনীতির রক্ষার জন্য আকিজ উদ্দিনসহ এস আলম গ্রুপের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। তাঁদের অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়।