কেমন করে যে এতগুলো বছর পার হয়ে গেল, হুমায়ুন আহমেদ বিহীন বাংলা সাহিত্য—এ যেন কল্পনাই করা কঠিন! তাঁর লেখা যেমন আনন্দ আর বিষাদের এক অনন্য মিশ্রণ, তেমনই আমাদের জীবনের একটা মায়াভরা অংশ। আজও মনে পড়ে, তাঁর প্রথম বই হাতে পাওয়ার সেই মুহূর্তগুলো; প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন নতুন এক পৃথিবীতে নিয়ে যেত আমাকে। বাংলা সাহিত্যে তাঁকে পেয়ে আমাদের কতটা সৌভাগ্য হয়েছিল, সে ভাবতে গেলে এখনও বিস্ময়ে থমকে যাই।
এই কিংবদন্তির পাঠে একসময় ডুবে গিয়েছিলাম আমি, যেন এক জাদুর জগতে প্রতিদিন নতুন করে প্রবেশ করতাম। তাঁর সৃষ্টি থেকে অজস্র লেখার প্রেরণা পেয়েছি, পেয়েছি এক নীরব সঙ্গী। আজ তাঁর সাহিত্যজগতে নিজের কলম নিয়ে প্রবেশ করতে চলেছি; এ যেন আমার কাছে এক পূর্ণতার উপলব্ধি। তাঁর সাহিত্যজগতে ডুবে থাকা সেই পাঠকের আজ লেখকের ভূমিকা নেওয়ার এই ক্ষণে নিজেকে পরিপূর্ণ সৌভাগ্যবান মনে করছি। হুমায়ুন আহমেদ—বাংলা সাহিত্যের এমন এক জাদুকর, যিনি পাঠকের হৃদয়ে আবেগের ঢেউ তুলতে পারেন খুবই সাধারণ ভাষায়। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে বুঝি, তিনি কেবল একজন কথাশিল্পী ছিলেন না; তিনি ছিলেন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অনুরণন, আমাদের হাসি-কান্না, বেদনা আর আনন্দের সঙ্গী।হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্যে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন আমরা আমাদের পরিচিত এক জগতেই ফিরে আসছি। তাঁর গল্পে উঠে এসেছে সেই ছোট ছোট দৃশ্যাবলী, যা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটছে, কিন্তু হয়তো আমরা তা দেখতে পাই না। তাঁর চরিত্রগুলো—হিমু, মিসির আলি, রূপা, শুভ্র—এরা আমাদের জীবনের এতটাই ঘনিষ্ঠ যে আমরা হয়তো এদের সাথে একাধিকবার মুখোমুখি হয়েছি। হিমু যেন আমাদের সবার মধ্যেই আছে—এক উদাসী, বাউণ্ডুলে, সমাজের নিয়মকে তোয়াক্কা না করা এক চরিত্র, যে নিজের মতো করে জীবনকে দেখার এবং বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা করে। মিসির আলি আমাদের মাঝে সেই জিজ্ঞাসু মনকে তুলে ধরে, যে সবকিছুর পেছনে রহস্য খুঁজে ফেরে। হুমায়ুন আহমেদ সেই দুর্লভ শিল্পী, যিনি কঠিন বিষয়ের গভীরে যেতে পেরেছেন সহজ ভাষার মাধ্যমে। তাঁর উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে সমাজের নানা অসঙ্গতি, মানুষের জীবনযুদ্ধের গল্প, আমাদের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আর বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। তাঁর ‘নন্দিত নরকে’ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন প্রবাহ নিয়ে এসেছিল। এই উপন্যাসের ভাষা, কাহিনি বিন্যাস, চরিত্রায়ণ সবকিছুই তখনকার সাহিত্যধারায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তিনি শুধু একজন লেখক ছিলেন না, ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোতে সমাজের বৈচিত্র্য আর সৌন্দর্যের নিপুণ প্রকাশ দেখা যায়। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘দুই দুয়ারী’ কিংবা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’—এই ছবিগুলো শুধু আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি হয়নি, এগুলো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তাঁর সিনেমার সংলাপ আর গানে আমরা পাই আমাদের জীবনের অনেক খণ্ডচিত্র। বিশেষ করে তাঁর নির্মিত যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।
হুমায়ুন আহমেদ তাঁর সময়ের সাহিত্যিকদের মধ্যে আলাদা ছিলেন তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ লেখার জন্য। তিনি জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন এবং সেটি তাঁর সাহিত্যে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। তিনি আমাদের প্রেমের এক বিশেষ সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা হয়তো কোনও বড় আকারের উপমা বা দার্শনিক বর্ণনায় ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং ছোট ছোট কথায়, গভীরতাহীন সংলাপে তিনি প্রেমের সেই মিষ্টি রূপটি তুলে ধরেছেন, যা আমাদের মনে অনুরণন তোলে। তাঁর কবিতার বইগুলোতেও দেখা যায় এক চিরন্তন প্রেম আর কল্পনার ছোঁয়া। ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ কিংবা ‘যখন ঝরবে বৃষ্টির জল’ বইগুলো পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তাঁর লেখার মধ্যেই বয়ে গেছে এক নির্ভেজাল আবেগের স্রোত, যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এমনকি তাঁর নাটকগুলোও আমাদের জীবনের টুকরো টুকরো দৃশ্য—’কোথাও কেউ নেই’ কিংবা ‘আজ রবিবার’ নাটকগুলো আজও আমাদের কাছে জীবন্ত, আমাদের স্মৃতির অংশ। সাহিত্যের পাশাপাশি বিজ্ঞানেও তাঁর আগ্রহ ছিল অগাধ। তাঁর কিছু বই, যেমন ‘অচিনপুর’, ‘পাখি আমার একলা পাখি’—এসব বইয়ে তিনি বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বকে এত সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা সাধারণ পাঠককেও আকর্ষণ করে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র মিসির আলি এক বিজ্ঞানমনস্ক অধ্যাপক, যিনি প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করেন যুক্তির আলোকে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই যুক্তিপ্রবণ চরিত্রটির সাথেই হুমায়ুন আহমেদ বারবার এমন রহস্যময় ঘটনার সংযোগ ঘটিয়েছেন, যা আমাদের চিরচেনা যুক্তির বাইরে।
হুমায়ুন আহমেদের জীবন ছিল নাটকীয়তায় ভরা। তিনি শুধু লেখক নন, ছিলেন একজন শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার এবং নাট্যকার। জীবনের শেষদিকে এসে তাঁর ক্যান্সারের সাথে লড়াই, নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে চিকিৎসাধীন থাকা—এ সবকিছুই যেন তাঁর জীবনের নাটকীয়তার একটি অংশ হয়ে গেছে। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার সাহিত্য যেন তার এক বিরাট অংশ হারিয়ে ফেলেছে। তবুও, তিনি আজও আমাদের মাঝে আছেন। তাঁর লেখাগুলো আমাদের জীবনে যেমন আলো ছড়ায়, তেমনই স্মৃতিতেও বাঁচিয়ে রাখে তাঁকে। তাঁর লেখা বই, সিনেমা আর নাটকগুলো তাঁর স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করেছে। হুমায়ুন আহমেদ আমাদের জন্য রচনা করে গেছেন এক অন্যরকম স্বপ্নময় জগৎ, যেখানে আমরা হাসতে পারি, কাঁদতে পারি, অনুভব করতে পারি। আজকের এই দিনে আমরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি, স্মরণ করছি তাঁর সৃষ্টি আর তাঁর জীবনকে। হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে আছেন আমাদের মনের গভীরে, আর থাকবেনও—যতদিন এই পৃথিবীতে বাংলা ভাষার পাঠক আছে, যতদিন মানুষের জীবনে তার সাহিত্যের প্রয়োজন থাকবে।
হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন এক প্রজ্ঞাবান স্রষ্টা, যিনি বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জীবন, স্বপ্ন, দুঃখ, প্রেম—সবকিছুর মাঝে এক নিবিড় অনুভূতির ছোঁয়া দিয়েছেন। তাঁর এই ৭৬ তম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে মনে হয়, তিনি চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি আজও আমাদের মনকে উজ্জীবিত করে, বেঁচে থাকার মানে শেখায়, কখনো বা আমাদের অশ্রুজলে সিক্ত করে।
তাঁর সৃষ্টির বৈচিত্র্য, সহজ-সরল বাক্যগঠনের মাধ্যমে গভীর জীবনবোধের প্রকাশ আমাদের জীবনে অন্যরকম এক প্রভাব ফেলেছে। জীবনের ছোট ছোট সুখ, কষ্ট, আশা-আকাঙ্ক্ষা, নিত্যদিনের সংগ্রাম—সবকিছুতেই তিনি জাদুর মতো প্রাণের স্পর্শ এনে দিয়েছেন। তাঁর লেখায় জীবনের গভীরতা এমনভাবে ফুটে উঠেছে, যেন মনে হয় প্রতিটি গল্প, প্রতিটি উপন্যাস আমাদের জন্য লেখা, আমাদেরই জীবনের অংশ। আজকের এই দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে হয়, হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন সেই দিশারী, যিনি আমাদের জীবনকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছেন। তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্য আমাদের জীবনে চিরকাল বেঁচে থাকবে—আমাদের হাসাবে, আমাদের কাঁদাবে, আবার আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।
হুমায়ুন আহমেদকে আমরা হারাইনি, বরং তিনি প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে আছেন এবং থাকবেনও—যতদিন আমরা তাঁর সৃষ্টিতে আমাদের জীবনের ছায়া খুঁজে পাব।
লেখকঃ চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান ও যুগ্ন সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আওয়াজ -The Daily banner, এবং গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক।