চট্টগ্রাম নগরজুড়ে এক নজিরবিহীন গ্যাস সংকট শুরু হয়েছে। মৌসুমী বায়ুর সক্রিয়তায় সাগরে সৃষ্ট বিশাল ঢেউ ও প্রবল বাতাসের কারণে মহেশখালীতে ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) থেকে এলএনজি খালাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় এলএনজিনির্ভর চট্টগ্রামে গ্যাসের চাপ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে, যার পরিণতিতে শিল্প-কারখানা, আবাসিক এলাকা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট—সবখানে চলছে চরম দুর্ভোগ। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. শফিউল আজম খান জানিয়েছেন, “মহেশখালীতে সাগরের উত্তাল অবস্থার কারণে এলএনজিবাহী জাহাজ থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহে ব্যাপক চাপ পড়েছে।” তিনি আরো বলেন, “যেখানে দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসার কথা, সেখানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৯৫ মিলিয়নে, যা শূন্যের দিকে চলে যাচ্ছে।” শুধু শিল্পখাত নয়, বাসাবাড়িতেও রান্নাবান্নাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে দেখা দিয়েছে অসহনীয় ভোগান্তি। গৃহিণীরা সকাল থেকে চুলা জ্বালাতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। শিশুদের খাবার, অসুস্থদের পুষ্টিকর খাদ্য, এবং বয়স্কদের জন্য গরম পানি—সবই বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস না থাকায় অনেকে হোটেল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন, অনেকে আবার বিকল্প জ্বালানির খোঁজে ছুটছেন।
অপরদিকে, গার্মেন্টস ও বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা পড়েছেন ভয়াবহ ক্ষতির মুখে। বিজিএমইএ’র নবনির্বাচিত পরিচালক এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “হঠাৎ করে এমন সংকট মেনে নেওয়া যায় না। আগাম পরিকল্পনার ঘাটতির জন্যই চট্টগ্রামবাসী বারবার বিপদে পড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নতুন কিছু নয়। সরকারকে সময়মতো বিকল্প চিন্তা করতে হবে।” চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন বলেছেন, “এই সংকট পূর্বপ্রস্তুতির অভাবের জ্বলন্ত উদাহরণ। দুর্যোগপূর্ণ মৌসুমে সাগরের অবস্থা খারাপ হতেই পারে—তা বিবেচনায় নিয়েই পূর্ব থেকেই পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি করে মজুদ রাখা উচিত ছিল। আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করা গ্যাসের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছি, অথচ দেশে উৎপাদিত গ্যাস এখনো প্রান্তিক জনগণ বা বৃহৎ শহরগুলো ঠিকভাবে পাচ্ছে না।” তিনি আরও বলেন, “বারবার গ্যাস সংকটের মতো অবস্থা হলে চট্টগ্রামে বসবাস ও ব্যবসা দুটোই কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারকে এখনই কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে যেতে হবে। শুধুমাত্র জাতীয় গ্রিডে সংযোগ দিলেই হবে না, দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা যেমন – গ্যাস সংরক্ষণ ব্যবস্থা, এলএনজি ট্যাংকার স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, বৈচিত্র্যময় উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহের উদ্যোগ – এগুলো জরুরি।”
এদিকে, চট্টগ্রাম একটি বন্দরনগরী এবং দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় গ্যাস সংকটের প্রভাব গোটা জাতীয় অর্থনীতিতেই পড়ছে। বন্দরের কার্যক্রমে গ্যাসচালিত যন্ত্রপাতি ও উৎপাদনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ছোট ছোট কারখানার শ্রমিকরা অচল অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, যাদের আয়-রোজগার এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত।
নগরের বাকলিয়া, মুরাদপুর, হালিশহর, আগ্রাবাদ, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, চকবাজার, পাহাড়তলীসহ অধিকাংশ এলাকায় গ্যাসের চাপ এতটাই কম যে চুলা জ্বালানো সম্ভব হচ্ছে না। নগরবাসী বলছে, “আমরা একটা দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলে বাস করি। সেটা সরকার জানে। অথচ কোনো আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। গ্যাস ছাড়া আমরা চলবো কীভাবে?”
চট্টগ্রামবাসীর দাবী, এলএনজি আমদানির সময় মৌসুম বিবেচনায় পর্যাপ্ত মজুদ রাখা,বিকল্প উৎস হিসেবে জাতীয় গ্যাস গ্রিড থেকে দ্রুত সংযোগ,এলএনজি স্টোরেজ সক্ষমতা বাড়ানো,সাগরে টার্মিনাল স্থাপন ও জাহাজ চলাচলে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন,দুর্যোগকালীন বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সরকার এখনো সংকট নিরসনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করেনি। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, সাগর শান্ত না হওয়া পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহ সম্ভব নয়। একটি প্রশ্ন এখন সবার মনে—চট্টগ্রামের মতো একটি শহর, যেখান থেকে দেশের বড় একটি রাজস্ব আসে, সেই শহরের নাগরিকদের গ্যাস সংকটের মতো মৌলিক দুর্যোগ কেন বারবার পোহাতে হয়?
চট্টগ্রামবাসীর এখন একটাই দাবি—এ সংকট নিরসনে সরকার যেন আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অন্যথায় জনজীবন ও শিল্পক্ষেত্রে স্থায়ী ক্ষতির সম্ভাবনা এড়ানো যাবে না।