আজকের ভোর যেন আল্লাহর রহমতের চাদরে মোড়ানো ছিল। আলো যখন অন্ধকার ভেদ করে পূর্বাকাশে নরম রোদের প্রথম রেখা ছড়িয়ে দেয়, আমি তখন হাঁটার জন্য বের হই প্রতিদিনের মতো। তবে এই সকালটা ছিল আলাদা। বাতাসে ছিল এক ধরনের স্নিগ্ধতা, যেন পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল হৃদয়ে। আমি হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম বাটালি হিলের অরণ্যঘেরা পথ ধরে, যেখানে গাছেরা যেন দাঁড়িয়ে আছে প্রভাতের প্রহরীর মতো, আর পাখিরা এক নিরবচ্ছিন্ন গজলের মতো গান গেয়ে চলেছে।
হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল এক কোমল দরুদের সুর—
“আমি দেখিনি তোমায় চোখের তারায়, তবুও তোমায় ভালোবেসেছি…”
কণ্ঠটি যেন আকাশ ছুঁয়ে আসছে। মনে হলো, এ কোনো সাধারণ গজল নয়, এটি নবীর প্রেমে ভেজা এক নিষ্পাপ শিশুর হৃদয়নিঃসৃত সুর।
আমার পা থেমে গেল। দূরে তাকিয়ে দেখি—লালখান বাজারের ‘আল-বারাকা ইসলামিক একাডেমি’র আবাসিক ছাত্রদের এক সারি পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে। মাথায় টুপি, পরিপাটি জোব্বা, পায়ে স্যান্ডেল, মুখে লাবণ্য আর চোখে আলো। যেন প্রতিটি শিশু এক একটি জীবন্ত আয়াত হয়ে হেঁটে চলেছে প্রভাতের কোরআনিক রাস্তায়।
তারা এসেছে ফজরের নামাজ শেষে, হুজুরদের সঙ্গ নিয়ে, ভোরের নির্মল প্রকৃতি ও শহরের ওপরে উঠে আল্লাহর সৃষ্টির অপার রহস্য দেখতে।
আমি হতবাক হয়ে দেখি তাদের সারিবদ্ধ চলা, কণ্ঠে দরুদ, চোখে প্রেম আর মনের গভীরে ইসলামি আদর্শের আলোকছায়া। তারা কেউ চঞ্চল নয়, কেউ বেপরোয়া নয়। বরং পাহাড় বেয়ে চলতে চলতে তারা আল্লাহর বন্দেগি করছে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে।
আমি এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। আমার পরিচয় জানিয়ে কথা বললাম। শিশুরা এমনভাবে আমার প্রশ্নের জবাব দিলো, যেন তারা আমার পুরনো বন্ধু। কেউ বলে, “এই পাহাড়ে এসে কোরআনের আয়াত মনে করি,” কেউ বলে, “আমরা চাই রোজ ভোরে উঠে নবীজিকে স্মরণ করতে।”
আমি বিস্মিত হই। আজকের শিশুদের নিয়ে যেখানে আমাদের সমাজে অসংখ্য হতাশা, সেখানে এই একঝাঁক কোরআনের পাখি যেন এক নতুন আশার আলো।
আমি জানতে চাইলাম—তারা কি জানে, কোরআনে পাহাড়, বৃক্ষ, প্রভাতের কথা এসেছে বহুবার? তারা মাথা নাড়ে, তাদের হুজুর বলেন, “প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যদি তা আল্লাহর সৃষ্টির প্রশংসায় রূপ নেয়।”
এই আলাপচারিতার মাঝে আমি তাদের একজনকে বলি, “একটা গজল গাও তো, নবীর প্রেমে ভরা কিছু।”
তখনই মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল নামের এক শিশু তার হৃদয় উজাড় করে দরুদ শুরু করে—তার সুরে ছিল শুদ্ধতা, কণ্ঠে ছিল রেওয়াজের চর্চা, আর চোখে ছিল নবীর প্রতি গভীর প্রেমের অশ্রু।
তার কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয়—
“তবুও তোমায় ভালোবেসেছি…”
আমার চোখে জল চলে আসে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, তার সাথীরা একযোগে তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে। যেন আকাশভরা তারা এক হয়ে গেছে এই দরুদের আলোতে।
আমি মুগ্ধ হয়ে তাদের পাশে গিয়ে বসি শতায়ু অঙ্গনের পাশে, যেখানে বসে তারা শহরের দৃশ্য দেখছে। চট্টগ্রামের ইট-কাঠের দালানগুলো তখন মনে হচ্ছিল—মানবজীবনের এক ক্লান্ত ছায়া, আর এই শিশুরা যেন সেই ক্লান্তিকে দূর করে দিচ্ছে আধ্যাত্মিক সজীবতায়।
তাদের হুজুরদের সাথেও কথা হয় আমার। জানি, এই একাডেমিতে প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্র রয়েছে, কিন্তু যারা সকাল সকাল হাঁটতে আসে, তারা সবাই আবাসিক। দেড় শতাধিক শিশুর প্রতিটি মুখে যেন আল্লাহর রহমতের প্রতিচ্ছবি।
এই মুহূর্তে আমার মনে হলো—এই শিশুরা একদিন সমাজের আলো হবে, জাতির গর্ব হবে, মানবতার পতাকা বহন করবে। তাদের হাতে গড়ে উঠবে এমন এক সমাজ, যেখানে মায়া, মমতা আর ধর্মীয় মূল্যবোধ আবার নতুন করে বাঁচবে।
আমি ছবি তুললাম তাদের সঙ্গে, কথোপকথনের শেষ না রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম—এদের নিয়ে আরও লিখতে হবে, আরও বলতে হবে।
আজকের সকালটা শুধু হাঁটার সকাল নয়, এটি ছিল এক আত্মার জাগরণ, এক নবচেতনার আগমন, এক নীরব শিক্ষার মুহূর্ত।
বাটালি হিলের সবুজ আচ্ছাদিত পরিবেশ, কোরআনের পাখিদের পদধ্বনি আর নবীর দরুদের সুর—সব মিলে এই সকাল হয়ে থাকলো আমার জীবনের এক পরম পবিত্র স্মৃতি।