একটি জাতির পরিচয় তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যে। কবরস্থান শুধু মৃতদের শায়িত করার জায়গা নয়, বরং এটি প্রজন্মের পর প্রজন্মের স্মৃতি বহনকারী এক পবিত্র স্থান। কিন্তু চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পশ্চিম চরণদ্বীপের নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর পারিবারিক কবরস্থান আজ এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। প্রশাসনের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ফলে এই ঐতিহাসিক কবরস্থানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আর ক্ষোভে ফুঁসছে এলাকাবাসী।
তিন শতাব্দীর কবরস্থানের ওপর দিয়ে রাস্তার পাঁয়তারা-
বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ মৌজার বিএস ১৩৯৭ দাগের কবরস্থান, যা প্রায় তিনশো বছর ধরে এলাকাবাসীর প্রয়াত স্বজনদের চিরশান্তির ঠিকানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সরকারি রেকর্ডে কিছু অংশ খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত হলেও দীর্ঘকাল ধরে স্থানীয় মুসলমানরা এটিকে তাদের পারিবারিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হিসেবে লালন করে আসছেন। কিন্তু সম্প্রতি বোয়ালখালীর এসি ল্যান্ডের এক মৌখিক নির্দেশে এই ঐতিহাসিক কবরস্থানের একাংশ সর্বসাধারণের চলাচলের রাস্তা হিসেবে উন্মুক্ত করার কথা জানানো হয়। স্থানীয়দের ভাষায়, এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্র। কবরস্থানের সম্মান নষ্ট করে একটি প্রভাবশালী মহল নিজেদের স্বার্থে রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে গড়মিল, প্রশাসনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন-
এলাকাবাসীর দাবি, এসি ল্যান্ডের নিযুক্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে কবরস্থানের আসল চিত্র তুলে ধরেননি। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএস ১৩৯৭ ও ১৩৮৭ দাগে কিছু অংশ কবরস্থান ও কিছু অংশ মাদ্রাসা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে কবরস্থানটি যে প্রাচীন আর এস ও সিএস জরিপ অনুযায়ী কবরস্থান হিসেবেই বিদ্যমান ছিল, তা উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৫ সালে এই কবরস্থান রক্ষার জন্য স্থানীয় নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে একটি সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি ছিল কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য, কোনো নতুন স্থাপনা গড়ে তোলার জন্য নয়। অথচ তদন্ত প্রতিবেদনে একে নতুন স্থাপনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সত্যের অপলাপ।
দখলের অভিযোগ, অথচ প্রশাসন নীরব!
এলাকাবাসীর দাবি, কবরস্থানের মূল জায়গার একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে কিছু প্রভাবশালী মহল দখল করে নিয়েছে। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে। অথচ প্রশাসন এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং সরকারি জমির দোহাই দিয়ে এখন কবরস্থানের কিছু অংশ সাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এলাকাবাসী প্রশ্ন তুলেছেন—
যখন কবরস্থানের জায়গা দখল করে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলা হলো, তখন প্রশাসন কোথায় ছিল?
যদি এটি খাস জমি হয়, তাহলে এতদিন যারা ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন?
কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট করে রাস্তা বানানোর উদ্দেশ্য কী?
প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনরোষ, সংঘর্ষের আশঙ্কা-
বোয়ালখালীর সাধারণ মানুষ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে প্রতিবাদ শুরু করেছে। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে—
কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে, এর ভেতর দিয়ে কোনো রাস্তা হবে না।
যারা কবরস্থানের জমি দখল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এসি ল্যান্ডের মৌখিক নির্দেশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসি ল্যান্ড যদি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করেন, তাহলে এই ইস্যুতে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে সংঘর্ষের সৃষ্টি হতে পারে, যার সম্পূর্ণ দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে।
সরকার কি কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষায় দায়িত্বশীল থাকবে?
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বোয়ালখালীর সচেতন মহল মনে করছে, এটি কেবল একটি এলাকার সমস্যা নয়, বরং এটি জাতীয়ভাবে ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
একটি শতাব্দীপ্রাচীন কবরস্থানের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ কি ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য? যদি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে এটি কি দেশের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী কবরস্থান রক্ষার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না?
সরকার কি জনগণের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেবে, নাকি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাবে? সময়ের হাতে সেই উত্তর রেখে, এলাকাবাসীর একটাই দাবি—
“আমাদের পূর্বপুরুষদের কবরের ওপরে কোনো রাস্তা হবে না!”