চট্টগ্রামে র্যাব-৭ এর অবৈধ অভিযান নিয়ে আইএইচআরসি’র সংবাদ সম্মেলন-
সাজানো ইয়াবা মামলা, কুড়ি লক্ষ টাকার আত্মসাৎ ও ক্রসফায়ারের হুমকি থেকে ন্যায়বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ-
চট্টগ্রামে র্যাব-৭, সিপিসি-৩ কর্তৃক অবৈধ অভিযান, সাজানো ইয়াবা মামলা এবং কোটি টাকার আত্মসাতের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন (আইএইচআরসি) বাংলাদেশ চ্যাপ্টার কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত এবং সংশ্লিষ্ট র্যাব সদস্যদের শাস্তির দাবিতে বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনের মূল বক্তব্য- আইএইচআরসি’র বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি ও ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের পক্ষে দায়ের করা মামলার বাদী সাবেক ছাত্রনেতা এম এ হাশেম রাজু সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। অথচ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এক প্রবাসফেরত সাধারণ ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। র্যাব-৭, সিপিসি-৩ অবৈধভাবে তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে এবং কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছে। তিনি বলেন, এই ঘটনা শুধু একটি পরিবারের বিরুদ্ধে অন্যায় নয়, বরং গোটা সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, সাজানো মামলা ও ক্রসফায়ারের হুমকির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
ভয়ংকর ১২ জুনের রাত -ভুক্তভোগী আইয়ুব আলীর পরিবারের বর্ণনায় জানা যায়, ২০২৫ সালের ১২ জুন সন্ধ্যায় চান্দগাঁও ক্যাম্পের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাওহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে র্যাব-৭ এর একটি দল কোনো আদালতের অনুমোদন ছাড়াই বাকলিয়ার কল্পলোক আবাসিক এলাকায় তাদের বাসায় অভিযান চালায়। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে এ অভিযান। অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই আইয়ুব আলী ও তার স্ত্রীকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রাখা হয়। দুই বছরের শিশুসন্তানকে কোলে নিয়েও আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় তার স্ত্রীকে। অভিযানের পুরো সময় পরিবারকে এমনভাবে আতঙ্কিত করা হয় যেন তারা কোনো আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের অংশ।
আইয়ুব আলীর অভিযোগ, অভিযানের সময় র্যাব সদস্যরা বাসার জিনিসপত্র তছনছ করে এবং ঘরে রাখা ৩৩ লাখ টাকা থেকে লুট করে নেয় ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ জব্দ তালিকায় দেখানো হয় মাত্র ১২ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ টাকা। বাকি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। সাজানো মামলা ও ইয়াবা নাটক- পরের দিন ১৩ জুন আইয়ুব আলীর বিরুদ্ধে বাকলিয়া থানায় মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নম্বর-২৩)। অভিযোগপত্রে বলা হয়, তার কাছ থেকে ২২৩ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ওই মামলার কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই, নেই ভিডিও ফুটেজ, নেই জব্দ তালিকার প্রমাণ। কেবলমাত্র মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে এ মামলা সাজানো হয়েছে। এম এ হাশেম রাজুর ভাষায়, “এটি একটি পরিকল্পিত নাটক, যা একজন নিরপরাধ ব্যবসায়ীকে ফাঁসাতে রচিত হয়েছে।”বপরিবারের ওপর অমানবিক আচরণ- সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অভিযানের সময় কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন না, যা প্রচলিত আইনবিরোধী। আরও অভিযোগ ওঠে, মহিলা পুলিশ ছাড়াই পুরুষ র্যাব সদস্যরা আইয়ুব আলীর স্ত্রীকে হেনস্তা করেন। বিষয়টি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন বক্তারা।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ
আইয়ুব আলী অভিযোগ করেন, সাতকানিয়ার স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. আবু তৈয়ব, তার ভাই শহিদুল ইসলাম বাবু (সিনিয়র সহ-সভাপতি, উত্তর সাতকানিয়া সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ) এবং বাবুর স্ত্রী মুন মুন র্যাব সদস্যদের প্রভাবিত করে এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছেন। পারিবারিক জমি বিরোধ এবং রাজনৈতিক শত্রুতার কারণেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
কে এই শহিদুল ইসলাম বাবু?
সংবাদ সম্মেলনে শহিদুল ইসলাম বাবুকে “ভয়ের নাম” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। বক্তারা বলেন, তিনি রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে এলাকায় এক সন্ত্রাসী শক্তি গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে—
১. ওমরাহ ও হজ এজেন্সির আড়ালে কোটি কোটি টাকা পাচার, ২. রোহিঙ্গা পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা,
৩. ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকা, ৪. স্থানীয় দালাল ও গুন্ডাদের পৃষ্ঠপোষকতা, ৫. রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার। বক্তারা দাবি করেন, আওয়ামী লীগের কিছু সুবিধাভোগী নেতার ছত্রছায়ায় থেকে বাবু আইনের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
আইএইচআরসি’র দাবিসমূহ- সংবাদ সম্মেলনে আইএইচআরসি বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি উত্থাপন করা হয়: ১. আইয়ুব আলীর বাসায় অভিযানের নিরপেক্ষ তদন্ত। ২. আত্মসাৎকৃত ২০,৫৬,৫০০ টাকা ফেরত প্রদান। ৩. সাজানো ইয়াবা মামলা প্রত্যাহার। ৪. আইয়ুব আলীর স্ত্রীর সঙ্গে অমানবিক আচরণের বিচার। ৫. পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৬. শহিদুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করা। আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি-
এম এ হাশেম রাজু জানান, আইয়ুব আলী ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইজিপি, র্যাব মহাপরিচালক, দুদক চেয়ারম্যান, সিএমপি কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতে একটি মামলা (স্পেশাল নং-০৫/২০২৫, তারিখ-১৩/০৮/২০২৫) দায়ের করেছিলেন। তবে ৭ সেপ্টেম্বর বিচারকের বদলি জনিত কারণে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এখন তিনি হাইকোর্টে আপিল ও রিট দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মানবাধিকারের প্রশ্ন- হাশেম রাজু বলেন, “র্যাবকে আন্তর্জাতিকভাবে ইতোমধ্যেই অপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড আজ আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে কলঙ্কিত করছে। যদি এখনই এদের শাস্তি নিশ্চিত না করা হয়, তবে আগামী দিনে আরও নিরপরাধ মানুষ ভিকটিম হবে।” তিনি আরও বলেন, “সত্য যতই চেপে রাখা হোক, একদিন না একদিন তা প্রকাশ হবেই। আইয়ুব আলীর মতো একজন নিরপরাধ মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো কোনো সভ্য রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্কজনক।” সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন—মোঃ আব্দুল মোমেন চৌধুরী, প্রধান আইনজ্ঞ, আইনী সহায়তা সেল, আইএইচআরসি বাংলাদেশ,মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠক প্রফেসর ড. মালেক কাজী,প্রফেসর ড. ফেরদৌস আরা খান ,এস এম ফরিদ,মোঃ কামাল উদ্দিন, এছাড়া ভুক্তভোগী আইয়ুব আলী, তার স্ত্রী লুৎফুন্নেছা গোলাপ এবং বড় সন্তান মোঃ তারিকুল ইসলাম ফয়সালও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, আজ সমাজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। যদি আমরা সত্য ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে না দাঁড়াই, তবে বাবুর মতো চরিত্ররা প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষকে শিকার বানাবে। এখনই সময় প্রতিবাদ করার, মুখ খুলে বলার— “মিথ্যার সাম্রাজ্য যতই বড় হোক, সত্য একদিন তার ভিত কাঁপিয়ে দেবে।”