হামলা, বাধা, তবু বিজয়ের হাসি—চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের ঐক্য উৎসব পারকি সৈকতে গড়লো অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত
জীবন কখনো কখনো প্রতিবাদের মতো হয়ে ওঠে—যেখানে আনন্দটুকুও অর্জনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৫ সালের ১ মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে, চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের আয়োজিত বৃহৎ পেশাদার মিলনমেলা যেন তেমনই এক উদাহরণ হয়ে রইল। বাধা এসেছিল একাধিকবার, অপ্রীতিকর ঘটনা ছিল যাত্রাপথে, হামলার শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিক, এমনকি অনুষ্ঠানস্থলেও ছড়ানো হয়েছিল ভয়ের বাতাস। তবুও শত শত সাংবাদিক জড়ো হয়েছিলেন আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকতে, নিজেদের একতা, ভালোবাসা ও পেশাগত বন্ধনের বার্তা নিয়ে।
শুরুতেই প্রতিবাদের ধ্বনি
অনুষ্ঠানের সূচনালগ্নেই চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়নি এই প্রথম
সাংবাদিকদের গাড়িবহর। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা। জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদের সামনে ওয়াসা মোড় এলাকায় কয়েকজন অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত সাংবাদিকদের গাড়িতে উঠে পড়ে, চাবি ছিনিয়ে নেয় এবং কয়েকজন সাংবাদিককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় সাংবাদিক সমাজ চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে একটি প্রতিবাদী মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
মিছিলের নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী। তিনি বলেন, “আজকের এই দিন আমাদের জন্য কেবল উৎসবের নয়, প্রতিবাদেরও। পেশাগত দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকদের উপর এমন হামলা প্রমাণ করে এখনো আমাদের অনেক লড়াই বাকি।”
পারকি পৌঁছানোর সংগ্রাম
সাংবাদিকদের বহনকারী নির্ধারিত বাসগুলো বাধার মুখে পড়লেও কোনো শক্তিই থামাতে পারেনি তাঁদের দৃঢ় মনোভাব। কেউ নিজস্ব গাড়িতে, কেউ আবার অন্য সহকর্মীর সহায়তায়, প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েই পৌঁছেছেন পারকি সমুদ্রসৈকতে। যদিও পূর্বনির্ধারিত জায়গায় এবং সময়মতো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দেওয়া হয়নি, তারপরও সৈকতের কাছাকাছি এলাকায় বিকল্প ব্যবস্থায় আনন্দ-সম্মিলনের আয়োজন করেন সাংবাদিকরা।
রুদ্ধদ্বার আনন্দে সম্মিলন
খেলাধুলার পরিকল্পনা বাতিল হলেও ক্ষণিকের জন্যও হারায়নি মিলনমেলার মূল স্বাদ। পতেঙ্গা বিমানবাহিনীর রেস্ট হাউসে দুপুরের খাবারের এক অনন্য আয়োজন, মনোমুগ্ধকর সংগীতানুষ্ঠান, সহকর্মীদের আন্তরিকতা—সব মিলিয়ে দিনটি হয়ে ওঠে স্মরণীয়।
অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন কয়েকজন সাংবাদিক ও অতিথি শিল্পীরা। কিছুক্ষণ শব্দের ঝংকারে, কিছুক্ষণ মৌন সম্মতির ভেতরেই ফুটে উঠেছে এক আবেগঘন ‘আমরা’-র অনুভব। অনেকেই বলেছেন, “হয়তো পরিকল্পনা মতো হয়নি কিছুই, কিন্তু যা হয়েছে তা অন্তর থেকে হয়েছে। এটাই আমাদের সাফল্য।”
হামলার প্রতিবাদ এবং প্রশাসনের নীরবতা অনুষ্ঠানস্থলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হামলার ঘটনা এবং এর বিচার নিয়ে। উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকেই প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকায় হতাশা প্রকাশ করেন। একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, “প্রতিবছর শ্রমজীবী মানুষদের কথা বলি, কিন্তু নিজেরা যখন হামলার শিকার হই, তখন আমাদের কণ্ঠস্বর যেন শুনতে পায় না কেউ।”
আরেকজন যোগ করেন, “পুলিশ যদি দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তবে এ প্রতিবাদ শুধু এখানেই থেমে থাকবে না, আমরা বৃহত্তর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবো।”
একটি বন্ধনের বার্তা যারা আয়োজনের পেছনে ছিলেন, তাদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় অনেকেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
নওশের আলী খান, হোসাইন তৌফিক ইফতেখার, কামাল পারভেজ ও শিমুল নজরুল। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসিকতায় সম্ভব হয়েছে শত বাধা উপেক্ষা করে এই আয়োজন সফল করা।
এ আয়োজন যে কেবল ভ্রমণ ছিল না, তা প্রমাণ করেছে সাংবাদিকদের মধ্যকার সংহতি, সহমর্মিতা এবং আত্মসমালোচনার জায়গা।
দিন শেষে প্রাপ্তির আনন্দ ও অপ্রাপ্তির ক্ষোভ
অনেকের মধ্যে ছিল এক ধরনের প্রশান্তির হাসি—আমরা পেরেছি। আবার অনেকে ছিলেন চিন্তিত—এই যে হামলা, এই যে নিপীড়ন, এগুলো কেবল শুরু কি না!
তবে সবার মুখেই একটি কথা ছিল, “আমরা একসাথে ছিলাম, আছি এবং থাকবো। আমাদের ওপর হামলা মানে জনগণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা। তা সফল হবে না।”
প্রতিজ্ঞা ও প্রেরণা
এই দিনটি সাংবাদিক সমাজের কাছে হয়ে থাকলো এক নতুন প্রতিজ্ঞার দিন:
“আমি একজন সাংবাদিক। আমি সত্য, পেশাদারিত্ব ও সহমর্মিতার পক্ষে। আমি হিংসা, বিভেদ ও ঘৃণার বিরুদ্ধে। আমি একা নই, আমরা একসাথে।”