জোবায়েদার একটি ভাঙা হৃদয়ের কাব্য
জোবায়েদার মন যেনো বসন্তের প্রথম ফুলে ভরা বাগান, যেখানে প্রতিটি পাপড়ির ওপরে আঁকা আছে অনুভূতির গভীরতা। তার দিনগুলো যেন একেকটা স্বপ্নের মতো, যা কখনো নীরব, আবার কখনো আবেগে ভরা ঝড়ো হাওয়ার মতো। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে তার মনে উদয় হয় নতুন নতুন চিন্তা, হয়তো বা তার জীবনের হারানো সোনালী দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি। বছর কেটে গেছে, কিন্তু তার হৃদয়কে একটুও মলিন করতে পারেনি সময়ের হাত। সে এখনও মনে করে, সেই প্রথম পরিচয়ের দিনটি, যেখানে তার মনের গভীরতম কোণায় জন্ম নিয়েছিলো এক নিঃশব্দ আকর্ষণ। যেনো কোন এক মায়াবী সন্ধ্যায় হাত বাড়িয়ে ধরেছিলো অনন্ত ভালোবাসার হাতছানি, এবং তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে সেই মুহূর্ত বেঁচে থাকে। কখনো কখনো রাতের অন্ধকারে, চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ঢুকলে, তার মনে হয় যেনো চাঁদের প্রতিটি রশ্মি তার অনুভূতির সূক্ষ্মতাকে স্পর্শ করছে। তার মনের কল্পনার রঙিন ফুলগুলো তখন খেলে বেড়ায় গভীরতম চিন্তার বাগানে। পুরনো স্মৃতিরা তার কাছে ফিরে আসে – সেই হাসিগুলো, সেই মিষ্টি কথাগুলো, আর সেই দৃষ্টির পরশ, যা এখনও তার হৃদয়কে করে তোলে আর্দ্র।
জোনায়েদার অনুভূতি এমনই এক অনুভূতি, যা ভাষায় ধরা কঠিন। তার প্রেম, তার শূন্যতা, তার অপেক্ষা যেন এক দীর্ঘ অধ্যায়ের মতো। সে হয়তো জীবনের নানা বাস্তবতায় হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার মনের কোনে এখনও জ্বলছে সেই স্মৃতির প্রদীপ।
কিছু মানুষের জীবন যেন তাসের ঘরের মতো। উপর থেকে দেখলে মনে হবে এক অসম্ভব স্থিরতা, এক সম্পূর্ণতা, অথচ ভিতরে ভিতরে তারা গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি ইটের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শূন্যতা, প্রতিটি ফাঁকা স্থানে জমে থাকা নীরবতার ভার। জীবন এগিয়ে চলে, কিন্তু তাদের সেই ভাঙা স্বপ্ন আর ক্লান্ত হৃদয় আড়াল করে তারা মুখে হাসি ধরে রাখে। বাইরের জগত যাকে বলে “খাঁটি সুখী মানুষ,” তাদের কাছে সে এক অভ্যাস মাত্র, এক সামাজিক মুখোশ, যা পড়ে তারা অবলীলায় হাঁটতে পারে দিনের আলোয় কিংবা রাতের অন্ধকারে। এই মানুষদের রুটিন যেন প্রতিদিনের একটি নাটক। সকালে তারা নিজেকে ধুলো ঝেড়ে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা করে; রাতের গভীরে তারা আবারো নিজেকে ধ্বংসের দিকে ফেলে দেয়। এরা হয়তো বসন্তের পুষ্পের মতো ফুটে ওঠে না, তাদের হৃদয়ের কোনো শিউলি ফুলে ভরে না, সূর্যের আলো তাদের জীবনের কোনোরূপ মধুময় আনন্দে রাঙায় না। কিন্তু তবুও তারা বেঁচে থাকে, নিরন্তর। একঘেয়ে শুষ্কতার মাঝেও যেন তাদের জীবনের চাকা থেমে থাকে না।
এরা রাস্তার ধারের অযত্নে বেড়ে ওঠা নয়নতারা ফুলের মতো। যে ফুল গুলো ধুলোয় ঢেকে থাকে, যা কেউ চেনে না, তবুও তারা জীবনবোধের ছোঁয়ায়, আকাশের নিচে নিজের মতো করে ফুটে থাকে। এরা যেমন যত্নের অভাবে শুকিয়ে যায় না, তেমনি জীবনের কোনো কিছু না পেয়েও পৃথিবীর সৌন্দর্য বিলাতে থাকে। ধীর পদক্ষেপে তারা এগিয়ে চলে নিজেদের লক্ষ্যের দিকে, যা কখনোই কারো প্রশংসার জন্য নয়। এদের সৌন্দর্য যেন গোপন, যা শুধু প্রকৃতির চোখেই ধরা পড়ে। এমন মানুষগুলোকে দেখলে মনে হয়, তারা এক বিশাল কৃষ্ণচূড়া কিংবা বকুল গাছের মতো রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ। যত ঝড়-ঝাপটা আসুক, তারা নিজের শক্তিতে অবিচল থাকে। ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে গেলেও, তারা তবুও কারো মাথার উপর ছায়া দিতে কার্পণ্য করে না। তাদের জীবন যেন স্থির, সহিষ্ণু এবং অবিচল। ভালোবাসা হোক, আত্মত্যাগ হোক, তারা কাউকে দেয়ার ক্ষেত্রে কখনো পিছপা হয় না। এই মানুষগুলো অদ্ভুতভাবে নিজেরা কষ্ট পায়, কিন্তু অন্যকে সুখী রাখতে চায়। কিন্তু এই মানুষেরাই যখন আঘাত পায়, তখন দেখা যায় তাদের অন্য এক রূপ। যতটা শান্ত, ততটাই শক্তিশালী, ততটাই রুদ্ধশ্বাসে বিধ্বংসী। কারণ এদের ভালোবাসা যেমন গভীর, তেমনি ঘৃণাও। এরা ক্ষুদ্র আঘাত সহ্য করতে পারে, কিন্তু মনের বিশ্বাসে আঘাত পেলে তা মেনে নিতে পারে না। যে এদের সঙ্গে বেঈমানি করেছে, সেই মানুষ এদের জীবনে একটি চিরস্থায়ী দূরত্ব পেয়ে বসে। এরা ক্ষমাশীল হতে জানে, কিন্তু যেটা তারা ভেঙে গিয়েছে, তা আর পুনরায় জোড়া লাগাতে পারে না।
এসব মানুষ নিজেদের দুঃখের কথা কারো কাছে খুলে বলে না। এরা পাহাড়ের মতো নিজেদের ব্যথা নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখে, শুধু যখন ঝড় ওঠে তখন বুঝা যায় তাদের শক্তির আসল রূপ। এরা নিজের ক্ষত ঢেকে রাখে, তবে অন্যকে স্নিগ্ধতা দিতে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। জীবনের প্রতিটি একঘেয়েমির মাঝে থেকেও এরা হাসে, যেন রোদের মতো নির্মল। কারণ এরা জানে, তাদের দুঃখ আর বেদনা কারো বোঝা নয়। এদের মনের গভীর থেকে উঠে আসে এক আত্মশক্তির স্রোত, যা দিয়ে এরা নিজেদের মতো গড়ে তোলে।
কিছু কিছু মানুষ যেমন আকাশের মতো বিশাল, দূর থেকে সঙ্গ দেয়, কখনো পাহাড়ের মতো ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়ায়, আবার কখনো বৃষ্টির মতো ঝরে শীতল করে দিয়ে যায়। এরা নিজেরাই নিজেদের রোদে উজ্জ্বল হয়, অন্ধকারে আলো খুঁজে পায়, আর আনন্দের উৎস খুঁজে নেয় নিজের ভেতরেই। এদের চেনা সহজ নয়, কারণ এদের হাসির পেছনে লুকানো থাকে হাজারও গল্প, যা এরা কাউকে বলে না। এরা একদিকে যতটা কোমল, ততটাই কঠোর। নিজেদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে, অন্যকে সবসময় রক্ষা করে। জীবনের এমনই এক অপার রহস্যের বুননে গড়া এই মানুষগুলো। তাদের ভেতরের ভালোবাসা, ঘৃণা, সহিষ্ণুতা আর ক্ষমার গল্প একাকার হয়ে মিশে গেছে গভীরতর বোধে। তাদের জীবনের এই জটিল স্রোত তাদের নির্মাণ করে অন্যরকম। সেই ভালোবাসা আর ঘৃণা দুটোই যেন ভয়ংকর সুন্দর, যা সহজেই বোঝা যায় না। তাদের হৃদয়ের গহীনে তোলা প্রেম আর বিশ্বাস, আঘাত আর প্রতিশোধ, সবকিছু মিলিয়েই তারা হয়ে ওঠে এক জীবনধর্মী মানব—যারা বাইরে থেকে শান্ত, কিন্তু ভেতরে বয়ে চলে আবেগের অশান্ত সমুদ্র। এই মানুষগুলোর জীবনের কাব্য যেন এক অনন্ত সংবেদনশীলতার প্রতীক, যা শুধু সময়ের স্রোতে বহমান থাকে। এই লেখাসহ যা লেখা লেখক লিখেছে তা নিয়ে জোবায়েদার কোন আপত্তি নেই কিন্তু-জোবায়েদার পরামর্শ: প্রতারিত নারীদের এক অনুপ্রেরণার আহ্বান- প্রিয় বোনেরা,তোমাদের জীবনের বেদনা আর সংগ্রামের যে কাব্য এখানে লেখা হয়েছে, তা আমি পড়েছি গভীর মনোযোগ নিয়ে। মনে হলো, এই লেখা যেন আমাদের জীবনের ভাঙা সুরগুলোরই এক প্রতিধ্বনি। তবুও, আমি বলব, জীবন শুধুই ব্যথার গল্প নয়। প্রতিটি অন্ধকারের শেষে যেমন সূর্যের আলো আসে, তেমনি প্রতিটি ক্ষত থেকেও জেগে ওঠার শক্তি থাকে। এই লেখার প্রতিটি পঙক্তিতে আমি দেখতে পেলাম তোমাদের ভাঙা স্বপ্ন, আঘাত, আর প্রতারণার নিঃশব্দ আর্তনাদ। কিন্তু বোনেরা, মনে রেখো, তুমি যদি নিজেকে নয়নতারা ফুলের মতো ভাবো—যা অযত্নেও সৌন্দর্য বিলাতে পারে—তবে সেই সৌন্দর্যেই রয়েছে তোমার শক্তি। তোমার ভেতরেই আছে এমন এক আলো, যা অন্যের অন্ধকার দূর করতে পারে। তোমরা যারা প্রতারণার শিকার হয়েছো, তাদের জন্য আমার পরামর্শ হলো: নিজেদের কখনো তুচ্ছ ভেবো না। জীবন তোমাকে ভেঙেছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছো। বকুল কিংবা কৃষ্ণচূড়ার মতো, ঝড়-ঝাপটা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস রাখতে হবে। যারা তোমাকে আঘাত দিয়েছে, তাদের ক্ষমা করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি নিজের ভেতর থেকে খুঁজে বের করো। ক্ষমা করো তোমার নিজের শান্তির জন্য, কিন্তু ভুলে যেও না। তোমরা যারা ভালোবাসার জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছো, তাদের বলি, ভালোবাসার মূল্য কখনো কষ্ট নয়। যে ভালোবাসা তোমাকে আঘাত দেয়, সেটি ভালোবাসা নয়, সেটি এক ছলনা। আর সেই ছলনার মুখোশ ভেদ করে তুমি নিজের জন্য একটি নতুন পথ খুঁজে নিতে পারো। এই পথ কঠিন হতে পারে, কিন্তু সেই পথই হবে তোমার সত্যিকারের মুক্তির পথ। তোমাদের জীবনের গল্প যেন শুধু কষ্টের নয়, জেগে ওঠারও হয়। নিজের ভেতরের শক্তি আর ভালোবাসা দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করো। মনে রেখো, পৃথিবীতে কেউ তোমাকে পরাজিত করতে পারবে না যদি তুমি নিজেকে জিতিয়ে রাখতে পারো। প্রতিটি নারী যেন একটি পর্বত—শক্ত, অবিচল, আর অপরাজেয়।
তোমাদের জন্য রইল আমার ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণার অঙ্গীকার। -জোবায়েদাঃ জীবন যুদ্ধে বারবার পরাজিত জোবায়েদা নূর। তবে তার গল্প এখানেই শেষ নয়। জোবায়েদার মনের গভীরতম কষ্ট, তার সংগ্রামের নিরন্তর ছন্দ, এবং তার অস্তিত্বের লড়াই—সবটা হয়তো তুলধরা সম্ভব নয় কোনো শব্দমালায়। তবু, যেভাবে নদী জানে না তার শেষ গন্তব্য, জোবায়েদার জীবনও তেমনই এক বহমান স্রোত। তাঁর জীবনের প্রতিটি বাঁকেই যেন লুকিয়ে আছে একেকটি অধ্যায়। পরাজয়ের মাঝেও জেগে ওঠা সাহস, হতাশার অন্ধকারে আলোর সন্ধান, আর ক্লান্তির ভেতর লুকানো এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা। জোবায়েদার যাপিত দিনগুলো যেন একটি অসমাপ্ত কবিতা—প্রতিটি স্তবকে মিশে আছে তার হৃদয়ের নিভৃত আর্তি। তাঁর কথা বলার শেষ নেই। কারণ, জোবায়েদা শুধু একজন মানুষ নয়, তিনি এক প্রতীক—লড়াইয়ের, ভালোবাসার, আর টিকে থাকার। তার চলার পথ আজও অনেক দূর, অনেক গভীর। আর সেই পথের বাঁকে বাঁকে পড়ে আছে তার জীবনের অসংখ্য গল্প, যেগুলো এখনো লেখা হয়নি, এখনো বলা হয়নি। তাই, যদি শেষ বলেও কিছু থাকে, তবে তা আসলে এক নতুন শুরুর অপেক্ষা। জোবায়েদার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় নতুন করে জন্ম নেয় সাহিত্যের রসে। তার গল্পের শেষ নেই, কারণ জীবন নিজেই তো এক নিরন্তর লেখা।
লেখক, সাংবাদিক, কথা সাহিত্যিক, গবেষক ও টেলিভিশন উপস্থাপক,