“ওসি প্রদীপের ভাই সদীপ কই?”—এই প্রশ্ন আজকাল বহু মানুষের মুখে শোনা যাচ্ছে। প্রথমদিকে প্রশ্নটা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, মানুষ প্রদীপকে যেমন ভয় ও ঘৃণার সঙ্গে মনে রাখছে, তার ভাই সদীপ সম্পর্কেও সমান কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। প্রদীপের নাম উচ্চারণ মানেই মানুষের মনে ভেসে ওঠে এক ভীতিকর অধ্যায়—রক্ত, হত্যা, লুটপাট, নির্যাতন ও ভয়ের ইতিহাস। কিন্তু সদীপ? সে তো প্রদীপের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িত ছিল না। তবুও কেন তাকে ঘিরে এত প্রশ্ন, এত সন্দেহ?
প্রদীপ : ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের প্রতীক -প্রদীপ কুমার দাশ, সাবেক টেকনাফ থানার ওসি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই—শত শত মানুষকে বিনা কারণে গুলি করে হত্যা, পাখির মতো জীবন নিভিয়ে দেওয়া, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, নারী নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহার। এককথায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক আতঙ্কের নাম। অবশেষে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। এখন ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় কারাগারে বন্দি।
প্রদীপের পাপ এতই ভয়াবহ যে, তার পরিবারও সমাজে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হয়। তার ভাই সদীপও সেই ছায়া থেকে মুক্তি পাননি।সদীপ : প্রদীপের ভাই হওয়ার অভিশাপ-সদীপও পুলিশে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু প্রদীপের ভয়ঙ্কর অপকর্ম প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই তাকে নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে। সাধারণ মানুষ ধরে নেয়, দুই ভাই নিশ্চয়ই একই রকম। এটাই ছিল সদীপের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ। যদিও কোনো প্রমাণ নেই যে, ওসি সদীপ প্রদীপের মতো ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞে সরাসরি জড়িত ছিলেন, তারপরও তাকে নিয়ে নানা গুজব ছড়ায়। অনেকে বলেন, সদীপও নাকি আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন। আবার কেউ কেউ অভিযোগ তোলেন, তারা দুজনই ভারতের হয়ে কাজ করতেন—অর্থাৎ পুলিশের ভেতর থেকে ভারতের গুপ্তচর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। আন্দোলনের পর আক্রমণের লক্ষ্য সদীপ-২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন চরমে। আওয়ামী সরকারের আমলে যারা দমন-পীড়নে যুক্ত ছিলেন, তাদের তালিকা বানানো হয়। সেই তালিকায় প্রদীপের পাশাপাশি সদীপের নামও ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ও আন্দোলনকারীরা বিশ্বাস করত, পুলিশের নৃশংস দমন-পীড়নে সদীপেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ফলে তাকে খুঁজতে থাকে আন্দোলনকারীরা। শুধু আইনের কাঠগড়ায় নয়, আন্দোলনকারীদের একাংশ চেয়েছিল তাকে মব জাস্টিসের মাধ্যমে শাস্তি দিতে। একাধিকবার উত্তেজিত জনতা সদীপের বাসার সামনে যায়। ভাগ্যক্রমে সে সময় তিনি বাসায় ছিলেন না। পরে তিনি বুঝতে পারেন, দেশে থাকলে যে কোনো মুহূর্তে প্রাণ হারাতে হবে।পালিয়ে আমেরিকায় আশ্রয়-জীবন বাঁচাতে সদীপ শেষ পর্যন্ত আত্মগোপনে চলে যান। পরে গোপনে দেশ ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন। আমি সদীপের সঙ্গে তার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে তিনি স্বীকার করেন যে, বর্তমানে তিনি আমেরিকায় অবস্থান করছেন। তার বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট: “আমি মব জাস্টিসের শিকার হওয়ার আশঙ্কা দেখেছি। বারবার উত্তেজিত জনতা আমার বাসার সামনে এসেছে, আমাকে ও আমার পরিবারকে খুঁজেছে। যদি সেদিন বাসায় থাকতাম, নিশ্চিতভাবে আমার মৃত্যু হতো।
ওসি সদীপ আক্ষেপ করে বলেন, “মব জাস্টিস, বা মব অপরাধ করার জন্য উত্তেজিত ছাত্র জনতার আড়ালে একটি সন্তাসীদের গ্রুপ আমার বাসায় গিয়ে আমাকে না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানকে হুমকি দিয়েছে।”
প্রশাসনিক হয়রানির সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হতে পারত। তাই আমি চাকরি ছেড়ে জীবন বাঁচানোর পথ বেছে নিয়েছি। পুলিশের চাকরিতে অনুপস্থিত থেকে আমি আইন ভঙ্গ করেছি, এ জন্য রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চাইছি। তবে পালিয়ে যাওয়া আমার ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত নয়—পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে।” প্রশ্নের ভিড়ে সন্দেহ আর কৌতূহল- এখন প্রশ্ন হলো, ওসি সদীপ কি সত্যিই নির্দোষ? তিনি কি কেবল ভাই প্রদীপের ছায়ায় ঢাকা এক পরিস্থিতির শিকার, নাকি তার ভেতরেও লুকিয়ে আছে অপরাধের ইতিহাস?কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ আজও প্রকাশ হয়নি। কিন্তু মানুষের অবিশ্বাস, গুজব আর প্রদীপের অমানবিক ইতিহাস সদীপকেও সন্দেহের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। সত্যিই কি তিনি কেবল পরিস্থিতির শিকার? নাকি নিজের অপরাধ থেকে পালানোর জন্য বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন? সময়ই দেবে উত্তর-ওসি সদীপ আজ আমেরিকায়। সেখানেই কাটাচ্ছেন নির্বাসিত জীবন। কিন্তু বাংলাদেশে মানুষ তাকে ভুলে যায়নি। প্রদীপের নামের সঙ্গে সঙ্গেই উচ্চারিত হয় সদীপের নামও—কখনো ঘৃণার সুরে, কখনো কৌতূহলের স্রোতে। সদীপ হয়তো নিজের মতো করে নির্দোষ দাবি করবেন। কিন্তু ইতিহাস, সময় এবং সত্যই একদিন তার স্থান নির্ধারণ করবে।ওসি সদীপ দেশে ফিরলে আদালত ও জনতার বিচারের মুখোমুখি হতে হবে-ওসি সদীপের নাম এখন কৌতূহল আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। প্রদীপের ছোট ভাই হওয়াটা তার জন্য যেন এক অভিশাপ। প্রদীপের ভয়ঙ্কর অপরাধ—শত শত মানুষকে হত্যা, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, নির্যাতন—সবকিছুর দায় সাধারণ মানুষ অবচেতনভাবেই সদীপের ওপর চাপিয়েছে। যদিও সরাসরি প্রদীপের মতো কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নেই, তবুও তাকে ঘিরে প্রশ্ন, সন্দেহ আর গুজব থামছে না। আমার মতামত- আমার দৃষ্টিতে, ওসি সদীপ যদি আবারও বাংলাদেশে ফিরে আসেন কিংবা এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তিনি দুই ধরনের বিচারের সম্মুখীন হবেন। প্রথমত, আইনের আদালত। একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও তিনি চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা অমান্য করেছেন। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগই থাকুক বা না থাকুক, পালিয়ে যাওয়াটাই তাকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। প্রশাসনিকভাবে অনুপস্থিতি, শৃঙ্খলাভঙ্গ, আর অভিযোগের জবাবদিহি থেকে তিনি মুক্ত থাকতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, জনতার আদালত। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রদীপের নামের সঙ্গে সদীপের নামও সমানভাবে ঘৃণা কুড়িয়ে নিয়েছে। জনতার মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে যে, প্রদীপের মতো সেও আওয়ামী সরকারের হয়ে দমন-পীড়নে যুক্ত ছিল। অনেকে আবার তাকে ভারতের দোসর বলেও আখ্যা দিয়েছে। এই অবস্থায় যদি তিনি দেশে আসেন, উত্তেজিত জনতা তাকে এক মুহূর্তও রেহাই দেবে না। তিনি নিশ্চিতভাবে মব জাস্টিস বা গণরোষের মুখে পড়বেন। সাধারণ মানুষের বিরূপ মন্তব্য- মানুষের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, সদীপের জন্য দেশে ফেরা মানেই ভয়াবহ ঝুঁকি। “প্রদীপের ভাই মানেই অপরাধী।”“যদি নির্দোষ হতো, তবে পালিয়ে যেত না।” “ওরা দুজনই শেখ হাসিনার সরকারের দোসর, ভারতের হয়ে কাজ করেছে।” “এদের জায়গা দেশের মাটিতে নেই, এদের জন্য কেবল জনতার বিচার অপেক্ষা করছে।” এইসব মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট, সাধারণ মানুষের মনে সদীপের জন্য কোনো সহানুভূতি নেই। ওসি সদীপ বর্তমানে আমেরিকায় আত্মগোপনে আছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তাকে ভুলে যায়নি। প্রদীপের রক্তমাখা নামের সঙ্গে তার নামও উচ্চারিত হয় বারবার। তিনি দেশে ফিরলে আদালত হয়তো তাকে ডাকবে, কিন্তু তারও আগে জনতার আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। সত্যিই কি তিনি শুধুই পরিস্থিতির শিকার, নাকি প্রদীপের মতো অপরাধী—এ প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, বাংলাদেশে ফিরলে ওসি সদীপকে আইনের কাঠগড়ার পাশাপাশি জনতার বিচারের ভয়ও বহন করতে হবে।