গণমানুষের সাহসী কণ্ঠের বিদায়:
মঈনউদ্দীন মহসিনকে স্মরণে আগামীকাল চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের আলোচনা সভা- ও কিছু কথা “‘
এক আত্মার সঙ্গী, এক কলমযোদ্ধা, এক অপূর্ণ অপেক্ষার নাম—মঈনউদ্দীন মহসিন বন্ধু মহসিন, তুই শুধু চলে যাসনি—তুই রেখে গেছিস এক সাহসী দর্শন, এক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, আর কিছু অসমাপ্ত স্বপ্ন। আমি কথা দিচ্ছি, তোর স্বপ্ন আমি বয়ে নিয়ে যাবো। তোর লেখা আমি ছড়িয়ে দেবো যতদূর যেতে পারি। আর ঠিক এই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর প্রতিশ্রুতি স্মরণেই— আগামীকাল ২১ জুন শনিবার বিকেল ৪টায়,চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম একাডেমিতে (মোমিন রোড)
মঈনউদ্দীন মহসিনকে স্মরণ করে
একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এই স্মরণসভা হবে শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়—এ হবে এক বন্ধুর প্রতি প্রাণভরা ভালোবাসার প্রকাশ, তাঁর আদর্শ ও ভাবনাগুলোকে নতুন করে ধারণ করার একটি শপথের মুহূর্ত। সবাইকে সেখানে উপস্থিত থেকে বন্ধু মহসিনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের বিনীত আহ্বান রইল। “গণমানুষের বন্ধু চিরবিদায় নিল—মঈনউদ্দীন মহসিন:
এক আত্মার সঙ্গী, এক সাহসী কলম, এক অপূর্ণ অপেক্ষা” জীবনের এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেখানে সময় থেমে যায় না ঠিকই, কিন্তু হৃদয় থমকে দাঁড়ায়। ঠিক তেমনই এক মুহূর্তের নাম ১৩ জুন, শুক্রবার। জুমার নামাজের পবিত্রতায় যখন চারপাশ মুখর ছিল সেজদার গুণগুণে—ঠিক তখনই আমার বন্ধু, সহযোদ্ধা, সহমর্মী এবং আত্মার আত্মীয় মঈনউদ্দীন মহসিন সেজদারত অবস্থায় নীরবে বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে। এমন মৃত্যু ঈমানদারদের জন্য সৌভাগ্য—তবে আমাদের জন্য, যারা তাকে ভালোবেসেছি, জেনেছি, ছুঁয়ে দেখেছি—তাদের জন্য এ এক অসহনীয় ক্ষতি, এক অপূরণীয় বেদনা। মসজিদের আঙিনা তখন যেন কান্নার সাগরে ডুবে গিয়েছিল। হাজারো হৃদয়ের হাহাকার, অশ্রুসিক্ত চোখের ভালোবাসায় মোড়ানো সেই শবযাত্রা, যেন প্রতিটি আত্মীয়, বন্ধু ও সহযোদ্ধার হৃদয়ে রচনা করল এক অমোচনীয় দাগ। সেই প্রিয় বন্ধুকে চিরশান্তির মাটিতে শোয়ানো হল, রেখে যাওয়া অগণিত স্মৃতি আর অসমাপ্ত স্বপ্নের ভার সঙ্গে নিয়ে। বন্ধু মহসিন—শুধু বন্ধু নয়, আত্মার একজন ছায়াসঙ্গী। তার কলম ছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার, তার চিন্তা ছিল সাহসের আলো। আমাকে সে ডাকত “বেয়াই”, কারণ তার মিষ্টি স্বপ্ন ছিল—আমার মেয়েকে তার ঘরের বউ হিসেবে আনার। এই স্বপ্নের ভেতর লুকিয়ে ছিল বন্ধুত্ব, আত্মিক ভালোবাসা এবং আত্মীয়তার এক অনবদ্য অনুভব। সেই ডাক, সেই স্বপ্ন আজ শুধু স্মৃতির পাতায়। আমাদের চার দশকের বন্ধুত্ব—রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আন্দোলন, সংগঠন—সব জায়গায় একসঙ্গে চলা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের রাজপথ থেকে শুরু করে নাগরিক ফোরামের প্রতিটি কর্মসূচিতে মহসিন ছিল আমার পাশে। সে ছিল একান্ত নির্ভরতার প্রতীক।
আমাদের জীবনের গভীরতাও মিলেছিল এক জায়গায়—দুজনেই হারিয়েছি আমাদের ভাইদের। মহসিন হারিয়েছিল তার দুই ভাইকে মব জাস্টিসে। আমি হারিয়েছি আমার ভাই আকতারকে, যার মৃতদেহ পর্যন্ত পাইনি। সেই যন্ত্রণা আমাদের মধ্যে গড়ে তুলেছিল এক অদৃশ্য কিন্তু অটুট বন্ধন।
বন্ধু মহসিন ছিল এক নিঃস্বার্থ চিন্তার মানুষ। তার লেখা “গণমানুষ: গণতন্ত্রের প্রকৃত তত্ত্বাবধায়ক”—এই বইটি হাতে দিয়ে বলেছিল, “বন্ধু, একটা আলোচনা লিখে দিও।” আমি কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু আজ সে নেই। এখন আমি লিখছি, কিন্তু তাকে পড়ে শোনাতে পারব না। তবুও, এই লেখার প্রতিটি শব্দ যেন আমার চোখের জল আর বুকের কান্নার সংমিশ্রণ।
বইটি পড়ে বিস্মিত হয়েছি—এ যেন এক প্রাতিষ্ঠানিক লেখক নয়, এক প্রতিবাদী হৃদয়ের নিঃশব্দ চিৎকার। বইটিতে রয়েছে—১৯৭১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতি, ইতিহাস, নারীর ভূমিকা, বুদ্ধিজীবী সমাজের ভাঙন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা, বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার তুলনামূলক বিশ্লেষণ—সবকিছু। কিন্তু কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু একটাই শব্দ—গণমানুষ। তার আগের কাব্যগ্রন্থগুলো—“মুক্তির মিছিলে” ও “ডেথলাইন বাংলাদেশ: যখন সন্ত্রাস এলো”—প্রমাণ করেছিল, সে কেবল রাজনীতিক নয়, এক বেদনাভরা কবিও। প্রতিবাদী কবি বলা হতো তাকে। যখন সবাই চুপ করত, তখন সে বলত—“এই দেশটা আমাদের, এই গণতন্ত্রটা আমাদের।” আজ সে নেই। কিন্তু তার শব্দ, চিন্তা, সাহস—সবই থেকে যাবে আমাদের মাঝে। আর সেই ভালোবাসা, সেই শ্রদ্ধা জানাতেই
👉 আগামীকাল ২১ জুন স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। এই দিনটিকে আমরা শুধু স্মরণসভা বলব না—এ হবে ভালোবাসা আর প্রতিশ্রুতির মিলনমেলা। যেখানে আমরা মহসিনের জীবন, চিন্তা ও সংগ্রামকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করব।
বন্ধু মহসিন, তুই শুধু চলে যাসনি—তুই রেখে গেছিস এক সাহসী দর্শন, এক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, আর কিছু অসমাপ্ত স্বপ্ন। আমি কথা দিচ্ছি, তোর স্বপ্ন আমি বয়ে নিয়ে যাবো। তোর লেখা আমি ছড়িয়ে দেবো যতদূর যেতে পারি।
ভালো থেকো বন্ধু, ভালো থেকো মহসিন।
তুই নেই, কিন্তু তোর কথা আজও বাতাসে ভাসে—
“এই দেশটা আমাদের, এই গণতন্ত্রটা আমাদের।”