১৯৮৭ সালের এক শরতের সকালে যখন গ্রামটায় নতুন শিক্ষক আসার খবর ছড়াল, তখনই শুরু হলো কৌতূহলের ঢেউ। ‘মেয়ে মানুষ আবার মাস্টার!’ — কেউ কেউ মুখ টিপে হাসল, কেউ বলল, ‘দেখি, কতদিন থাকে!’
কিন্তু দীপ্তি এসেছিলেন মনেপ্রাণে শিক্ষাদানের স্বপ্ন নিয়ে। তাঁর পরনে ছিল সাদা সালোয়ার-কামিজ, মুখে সহজাত দীপ্তি আর চোখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক। গ্রামের স্কুলে পা রাখতেই যেন সময় থমকে দাঁড়াল। বাঁশের কাঁচা ঘরে তখনো খুপরি খুপরি ক্লাস চলে, বাচ্চারা মেঝেতে বসে পড়ে। দীপ্তি আপা বলতেন, “শিক্ষা মানে শুধু বই মুখস্থ নয়, শিক্ষা মানে চোখ খোলা, মন খোলা, আর সবচেয়ে বড়—আত্মসম্মান।” শুরু থেকেই তিনি ছাত্রছাত্রীদের নাম ধরে ডাকতেন। তাদের হাসি, কান্না, স্বপ্ন—সবকিছুতে নিজেকে মিশিয়ে দিতেন তিনি।
তাঁর উপস্থিতিতে মেয়েরা যেন প্রথমবার স্কুলকে আপন করে নিতে শিখল। মায়েরা বলতেন, “এই প্রথম আমাদের মেয়েগুলো বলছে, তারা বড় হয়ে মাস্টার হতে চায়।”
তবে পথটা ছিল না মসৃণ। স্থানীয় এক চেয়ারম্যান একদিন বলেই বসেন, “আপনি ভালো করেন, শহরে ফিরে যান। গ্রামে এমন আধুনিকতা ঠিক না।” দীপ্তি হেসে বলেছিলেন, “অন্ধকারে থাকাটাই যদি আপনার ঠিক মনে হয়, তবে আমি আলোর ভুল করতে রাজি।”
এভাবে দীপ্তি শুধু পড়াননি, তিনি গড়েছেন মানুষ। একজন করে মেয়েকে তুলে এনে তিনি বদলে দিয়েছেন পুরো প্রজন্মের চিন্তাধারা। তার ছাত্রীরা আজ চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কেউ বা নিজের স্কুল গড়েছে।
সকালের আলো ছুঁয়ে যখন দীপ্তি স্কুলে পৌঁছাতেন, তখন অনেক সময় স্কুলের দরজা খুলত না। চাবিওয়ালা পিয়ন আসত দেরিতে, ছাত্রছাত্রীরা এলোমেলোভাবে খেলত উঠানে। একদিন তিনি নিজেই বয়ে আনলেন এক গুচ্ছ চাবি। বললেন, “এই স্কুল আমার দ্বিতীয় ঘর। দরজাও আমি খুলব, আলোও আমি জ্বালাব।”
প্রথম যেদিন তিনি কন্যাশিশুদের আলাদা করে ক্লাস করাতে চাইলেন, তখন কয়েকজন পুরুষ অভিভাবক বিরক্তি নিয়ে বলল, “মেয়েদের এত আলাদা যত্ন কেন? ওরা তো বিয়ে হলেই ঘর সামলাবে!”
দীপ্তি হেসে বললেন, “যারা ঘর সামলায়, তারাই তো জাতি গড়ার প্রথম হাতিয়ার। তারা শিক্ষিত হলে, পুরো জাতিই শিক্ষিত হবে।” তারপর থেকে প্রতি শুক্রবার বিকেলে মেয়েদের নিয়ে বসতেন একটি ‘বিশেষ পাঠচক্র’। সেখানে শুধু বই নয়, শেখাতেন আত্মসম্মান, আত্মরক্ষা, জীবনের লক্ষ্য স্থির করা। তিনি মেয়েদের বলতেন, “তোমাদের চোখে যেন আত্মবিশ্বাসের আলো থাকে, মাথা যেন উঁচু করে কথা বলো।”
এই পাঠচক্র থেকেই উঠে এলো এক স্বপ্নদ্রষ্টা মেয়ে—সাবিনা। বাবা দিনমজুর, মা গৃহকর্মী, মেয়েটি পড়ত দীপ্তির ক্লাসে। সবার চোখ এড়িয়ে একদিন সে দীপ্তিকে বলেছিল, “আপা, আমি বড় হয়ে আপনার মতো শিক্ষক হতে চাই।”
দীপ্তি তাকে খাতা-কলম দিলেন, বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে বোঝালেন, কেমন করে মেয়েটি একদিন আলো হয়ে উঠবে। আজ সেই সাবিনা নিজেই শহরের একটি নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।
দীপ্তির জীবন শুধু ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি গ্রামের মন্দির-মসজিদ, উঠোন বৈঠক, হাট-বাজার—সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন, মানুষকে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতেন।
কেউ একদিন তাকে বলেছিল, “আপনি তো শিক্ষক, রাজনীতির মতো কাজে নামছেন কেন?”
দীপ্তি বলেছিলেন, “যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছায় না, সেখানে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য মুছে যায়। আমি শুধু আলোটা পৌঁছে দিতে চাই।”
চলবে–