কাল সন্ধ্যার আলো নিভু নিভু, আকাশে রোজার শেষ বিকেলের মায়াবী রঙ, আর আমি বসে আছি আমার আগামী দিনের তিন কান্ডারী—কাশিব, কাইয়ান আর কাইয়ার সাথে। ইফতারের টেবিলটায় শুধু খাবারের স্বাদ ছিল না, ছিল একরাশ ভালোবাসা, নির্ভরতা আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তারা তিনজনই আমার একমাত্র ছেলে সাকিবের সন্তান। ছেলের প্রতি তেমন কোনো প্রত্যাশা নেই আমার, সে নিজের ছায়ার মতো এলোমেলো পথে হাঁটে। কিন্তু এই তিন রত্ন আমাকে আশার আলো দেখায়, আমার অস্তগামী দিনের রঙিন সূর্যোদয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
কাশিব: চাপা বেদনার নাবিক কাশিব আমার সবচেয়ে বড় নাতি। বয়স বাড়ছে, কিন্তু ওর কপালের ভাঁজও বাড়ছে সাথে সাথে। আমি জানি, ওর মনের গভীরে কিছু না বলা কথা আছে, কিছু চাপা কষ্ট আছে। মুখে প্রকাশ না করলেও ওর চোখে আমি সেই বেদনাগুলো পড়তে পারি। হাসিটা কমে গেছে, কেমন যেন চিন্তিত থাকে সবসময়। আমি বারবার ওকে খুঁজি, চেষ্টা করি ওর মনের গোপন দরজা খুলে দিতে। কিন্তু কাশিব নিজের জগতে ডুবে থাকে, কথার চেয়ে নীরবতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তবুও আমি জানি, ওর ভেতরটা কোমল, হৃদয়ে অনেক গল্প জমে আছে, যা একদিন ঠিকই বলবে আমাকে।
কাইয়ান: আমার একান্ত ভক্ত আমার মেজো নাতি কাইয়ান, সে একেবারেই আলাদা। কথার জাদুতে মুগ্ধ করে রাখে সবাইকে। অসম্ভব ভদ্র, সংবেদনশীল আর বুদ্ধিদীপ্ত। তার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সে আমাকে কতটা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। তার সামনের দাঁতের একটু সমস্যা আছে, শক্ত কিছু খেতে কষ্ট হয়, কিন্তু আনারসের প্রতি তার এক অদ্ভুত টান। হাসতে হাসতে বলে, “দাদা, এটা কিন্তু আনারশ না, এটা পাইন আপেল!” আমি হেসে বলি, “পাইন আপেল আর আনারস তো এক!” কিন্তু সে মানতেই চায় না। নিজের ভাবনাতেই অটল থাকে। আমি দেখি, কাইয়ানের মধ্যে এক ধরনের দৃঢ়তা আছে, একাগ্রতা আছে, যা তাকে ভবিষ্যতে অনেক বড় করবে।
কাইয়া: আমার ছোট্ট শাসক, আর আমার ছোট্ট কাইয়া—সে যেন আমার ভবিষ্যতের সেক্রেটারি! মাঝে মাঝে এমনভাবে ধমক দেয়, যেন আমিই তার অধীনস্থ! “এই দাদা, এটা করবা না!” “এই দাদা, ঠিক মতো বসো!”—এমন সব আদেশ শুনতে শুনতে হেসে ফেলি। আমার স্ত্রী সেলিনা আকতার কখনো আমাকে শাসিয়ে কথা বলে না, কিন্তু কাইয়া যেন দাদির পক্ষ থেকে সেই অভাব পূরণ করছে! দাদির মতোই দেখতে সে, শুধু চুলের ধরনটুকু আমার মতো খোকরানো। ওর চেহারায় আমি সেলিনার ছায়া দেখি, আর ওর ব্যক্তিত্বে দেখি ভবিষ্যতের আত্মবিশ্বাসী এক নারীকে।
ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা তিনটি রত্ন- এই তিনজনের মধ্যে সম্পর্কটা দারুণ। তারা একে অপরকে চোখে চোখে রাখে, খোঁজখবর নেয়। ভাইয়ের চেয়ে বোনের টান বেশি, কাইয়া যেন কাশিব-কাইয়ানের জন্য এক অভিভাবকের মতো। ওদের একসঙ্গে দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে এখনো সম্পর্কের গভীরতা আছে, আছে নিখাদ ভালোবাসার বন্ধন।
আমার স্বপ্ন: তাদের হাত ধরে আগামীতে আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, আমার এই তিন কান্ডারী একদিন আমার বংশের নাম উজ্জ্বল করবে। হয়তো তারা একেকজন একেক দিকে যাবে, একেকটা আলোকিত পথ বেছে নেবে। কিন্তু আমি জানি, তারা সৎ থাকবে, ভালো থাকবে, সত্যের পথ ধরে চলবে। আমি আজকের এই মুহূর্তটুকু ধরে রাখতে চাই, তাদের শৈশবের নির্মল হাসির আওয়াজটুকু সংরক্ষণ করতে চাই আমার হৃদয়ের গহীনে। ইফতারের টেবিলে যখন কাইয়ান মজা করে আনারস খাচ্ছিল, কাইয়া আমাকে আদেশ করছিল আর কাশিব চুপচাপ তাকিয়ে ছিল দূরে, তখন মনে হলো—জীবনটা আসলে এমনই। কেউ গল্প করে, কেউ শাসন করে, কেউ নীরবে ভাবনা গুছিয়ে নেয়। আর আমি? আমি তাদের দেখে স্বপ্ন দেখি, নতুন দিনের কান্ডারীদের হাতে আমার নাম, আমার বংশ, আমার ভালোবাসার রঙ দেখে আনন্দে বুক ভরে তুলি।