ব্যারিস্টার মনোয়ার এ-র বড় ভাই”
বোয়ালখালীর কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা- চট্টগ্রামের কৃতি ফুটবলার সাইফুল ইসলামের স্মরণে কিছু কথা।
আমাদের জীবনে প্রতিটি মানুষের কাছে মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে কঠিনতম সত্য কথা, মৃত্যু হচ্ছে মানুষের জীবনের এমন একটি নির্মম বাস্তব বিষয় যা আমাদেরকে মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর। তাই আজকের এই লেখার মাধ্যমে মৃত্যুর আবেগময়ী কথা গুলো বলার চেষ্টা মাত্র। প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমরা যে আঘাত পাই সেই আঘাতের কষ্ট দুঃখ কখনোই সইতে পারিনা। আমরা জানি এই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের মৃত্যু জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ কিন্তু তারপরও কিছু কিছু আপন মানুষের মৃত্যুতে আমাদেরকে চুড়ান্ত ভাবে শোকে ফেলে দেয়, আমাদের মাঝে অনুভব হয় সেই শূন্যতা সারাটা জীবন আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়।এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের জন্মের জন্য নিদিষ্ট একটি সময় রয়েছে কিন্তু মৃত্যুর জন্য নিদিষ্ট কোন সময় নেই। আমাদের প্রিয়জনের মৃত্যু হয় যখন, তখন আমরা শোকে কাতর হয়ে যাই। আমরা মেনে নিতে পারিনা প্রিয়জনের মৃত্যুকে, এখনো মেনে নিতে পারেনি কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলার সাইফুলের মৃত্যুকে। দীর্ঘ বছর অতিবাহীত হওয়ার পরও মেনে নিতে পাচ্ছে না সাইফুলের পরিবার। তেমনি এখনো মেনে নিতে কষ্ট পায় সাইফুলের খেলার সাথীরা। প্রতিবছর এই ১৯ শে ফেব্রুয়ারী আসলে কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলার সাইফুলকে মনে প্রাণে স্মরণ করেন সাইফুলের বেঁচে থাকা অন্য ভাই-বোনেরা-শুধু সাইফুলের পরিবার কেন আমরা যাঁরা সাইফুলের পরিবারের শুভ কাঙ্কিরা এবং সাইফুলের বীরত্ব গাঁথা কাহিনি শোনার মানুষেরা সাইফুলকে কখনো ভুলতে পারিনি ভুলতে পারবেনা। সেই সাইফুলের আমার কিছু কথা। সাইফুলের বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দেওয়ার মতো বয়স, না হলেও কিন্ত দেশের টানে, নিজ মাতৃভূমিকে ভালবেসে, দেশকে স্বাধীন এবং শত্রু মুক্ত করার জন্য একজন উঠন্ত বয়সের দূরন্ত ফুটবলার হাতে বোমা নিয়ে রাজাকার ও পাক বাহীনিকে আঘাত করতে এগিয়ে যাওয়া, সেই দামাল ছেলের বীরত্ব গাঁথা কথা কথা বলার আগেই আমি তাঁকে শ্রদ্বার সাথে স্মরণ করছি। ১৯ শে ফেব্রুয়ারী আমি যাঁর কথা লিখতে যাচ্ছি সেই কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম আমাদের কাছ থেকে অকাল বয়সে ট্রেন দুর্ঘনায় আহত হয়ে চিরতরে চলে যাওয়ার দিন। এই বীর সন্তান বেঁচে থাকলে আজ সোনার বাংলার, একজন কৃতি ফুটবলার হিসেবে সোনার ছেলে পরিচিত লাভ করতো। যে ছেলে কিশোর বয়সে দেশ প্রেমে আবদ্ধ হয়ে, মনের টানে মুক্তি যুদ্ধ করার জন্য অন্যান্য মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে সামিল হয়ে নিজের প্রাণকে হাতে নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও একেবারে কিশোর বয়সে ঝাপিয়ে পড়ে ছিলেন, তা একটি বীরত্বের ঘটনার ইতিহাস হয়ে আমাদের মনকে দারুণ ভাবে নাড়া দিয়েছে। তবে এই কিশোর বীরের- বীরত্বের কথা শুনে গর্বে বুক ভরে যাওয়ার কাহিনি লিখতে বসেছি তা করুন মৃত্যুর কথা।
১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক জাতীয় যুব ফুটবল দলের খ্যাতিমান ফুটবলার ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক সাইফুল ইসলাম এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ, জনপ্রিয় এই তরুণ ফুটবলার ১৯৭৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী সকাল ৯-৩০ টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। তিনি তাঁর মুরাদপুরস্হ বাড়ীর পাশে
চট্টগ্রামের ষোলশহর রেল স্টেশনের সন্নিকটে, চলন্ত ট্রেনের সাথে ধাক্কা লেগে মর্মান্তিকভাবে আহত হয়ে ঐদিনই দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালে হাজারো মানুষ ছুটে যান, এক কথায় হাসপাতেলে মানুষের ঢল পড়েযায় । সেই এত জনপ্রিয় ফুটবলার ছিলো যে এমন কেউ নেই তাঁর জন্য চেখের পানি ছাড়েনি। হাসপাতালেই দেখতে আসা তাঁদের অনেকের কান্নার শব্ধে ওখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে গিয়েছিল | তাঁর জন্য রক্তের প্রয়োজনের কথা জানতে পেরে কয়েকশো তরুণ ব্লাড ব্যাংকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছিলো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। হাসপাতালে নেয়ার পরে ইমার্জেন্সিতে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসার পরে যখন বুুঝতে পারলেন যে, তাঁর একটি পা আর নেই তখন তিনি চিৎকার করে বললেন, ” আল্লাহ আমার পা আর নেই, আমি আর ফুটবল খেলতে পারবো না, আমি আর বাঁচতে চাই না, আমাকেও নিয়ে যাও” তখন তাঁর কান্না ও চিৎকারে সব ডাক্তার, নার্স এবং উপস্থিত শত শত মানুষ কান্নায় ভেঙে পরে, যে মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, তাঁর বর্ণনা এখন এই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে সাইফুলের ছোট ভাই চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন কথাটি ভারাক্রান্ত মনে বলেছেনঃ তিনি দিয়েছেন “ভিবি শিখা সময়” বর্ননা। তাঁর চিৎকারে হাসপাতালের ভবন যেন কেঁপে উঠেছিল। তাকে ডাক্তাররা বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, আর্টিফিশিয়াল পা নিয়ে তুমি স্বাভাবিকভাবে চলতে পারবে, কিন্তু তাঁর ওই একটিই কথা আমি পা ছাড়া বাঁচতে চাই না। তাঁর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা, দীর্ঘ বছরের বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ চিকৎসক ডাঃ নুরুল হুদা সাহেব খবর পেয়ে তাঁর কর্মস্থল আর এক হাসপাতাল থেকে দ্রুত ছুটে এসে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে তাঁর ছেলের চোখ, হার্ট বিট, ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করে বেশ আশংকিত হয়ে গেলেন | অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো, সবাই অধীরভাবে অপেক্ষায় ছিলেন, হাসপাতাল প্রাঙ্গনে। হঠাৎ করে দুপুর বারোটা নাগাদ সবাইকে আকস্মিক ভাবে চমকে দিয়ে অবিস্বাশ্য এক খবর এলো ‘সাইফুল আর নেই। একথা শুনার সাথে সাথে ঐ সময়ে কি দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো তা সবাই বুঝতেই পারছেন | তাঁর প্রাণহীন দেহটি শহরের মুরাদপুরস্থ বাড়িতে নেয়ার আগেই সারা শহরে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে তাঁকে শেষ বারের জন্য দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন হাসপাতালে। এদের মধ্যে ছিলেন ক্রীড়াবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জেলা প্রশাসক, এমপি, ক্লাব-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, রাজীনৈতিক ইত্যাদি ব্যক্তিগণ, তখন ছুটি হয়ে যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অসংখ্য স্কুল ও কলেজ।সে সময় মুরাদপুর এলাকায় নির্মাণাধীন বিশ্বরোডের উপর অনুষ্ঠিত তাঁর জানাজাটি ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজা। মুরাদপুর মসজিদের পশ্চিমদিকে ঠিক মিম্বরের অতি স্বনিকটের পাকা কবরটিতে এখনো মার্বেল পাথরে খচিত রয়েছে ” কৃতি ফুটবলার মরহুম সাইফুল ইসলাম এ-র নাম” |
স্কুল জীবন থেকেই ফুটবলার ও স্পোর্টসম্যান হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন | মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তিনি ছিলেন প্রথম জাতীয় যুব ফুটবলের রানার্স আপ চট্টগ্রাম একাদশের, চট্টগ্রাম প্রথম বিভাগের অন্যতম সেরা সিজিএমসিএল(ইস্পাহানি ক্লাব) এর এবং ঢাকার প্রথম বিভাগে উয়ারী ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় | দুর্দান্ত সাহসী এক তরুণ মেধাবী ফুটবলার হিসাবে পরিচিত সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রামের ফুটবল মাঠের জন্য বিশ্বখ্যাত মেরাডোনার মতো আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিলেন দর্শকদের। দেশের যেখানেই খেলতে গিয়েছেন সেখানেই চমক সৃষ্টি করে আসেন। তাঁর অদম্য ক্রীড়া নৈপুণ্যের কারণে দর্শকরা সহসা মুগ্ধ হতেন, আর যেখানেই খেলতে যেতেন সেখানেই ক্রীড়া প্রেমীদের মুখে মুখে তাঁর নাম কয়েকদিন শুনা যেত। এভাবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের এমন কোনো অলি গল্লি ছিলোনা যেখানে তরুণরা সাইফুলের নাম জানতো না।
মানুষের বিপদে সাহায্যের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতেও এই দুর্দান্ত ফুটবলার হিসেবে পরিচিত সাইফুল কুন্ঠাবোধ করতো না। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা ছিল, ষোলশহর এলাকায় আগুনের মধ্যে সাহসিকতার সাথে একটি পরিবারের ছোট্ট শিশুকে উদ্ধার করা।
মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল :
১৯৭১ এর ৭ ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তি সংগ্রাম শুনে দেশের জন্য নিজকে তৈরি করেছিলেন, এবং সাইফুল ইসলাম মুরাদপুরে ষোলশহর এবং নাসিরাবাদ এলাকায় ছাত্র-তরুণদের নিয়ে ২৬শে মার্চের কিছুদিন আগে থেকেই ডামি রাইফেল ট্রেনিংয়ে অংশ নেন। সাইফুল ইসলাম মুরাদপুরের অতি সন্নিকটে বসবাসরত তৎকালীন অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ও সেখানকার অন্যান্য সেনা অফিসারদের সাথে পরিচিত হয়ে সখ্যতা গড়ে তোলার সম্ভব হয়েছিলো সেই একজন খেলোড়ার হওয়া এবং তাঁর খেলাধুলার কারণে। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন থেকে তাঁর বড়ো ভাই নজরুল ইসলাম হারুন ও তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের খাদ্য সরবরাহসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন | উল্লেখ্য যে, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘাঁটি ছিল তাঁদের শহরস্থ মুরাদপুরের বাড়ির অত্যন্ত সন্নিকটে, মাত্র ৫০০-৬০০ গজের মধ্যে, ওই রেজিমেন্টের কমান্ড্যান্ট কর্নেল জানজুয়া থাকতেন মাত্র ২৫০-৩৩০ গজের মধ্যে আর ক্যান্টনমেন্ট ৩ মাইল দুরুত্বে।২৬ মার্চ ওই রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা বঙ্গবন্ধুর ওই রাত্রে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার খবর পেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পাকসেনাদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং ওই ঘাঁটির আশপাশে নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির বাড়ি গুলিতে বসবাসকারী কর্নেল জানজুয়া ও বেশ কিছু পাকসেনা অফিসারদের গ্রেফতার বা হত্যা করেন | স্বাভাবিক ভাবেই একই সময়ে মুরাদপুর ও ষোলশহর এলাকা গোলাগুলি, আর্তনাদ ও হৈ চৈ এর শব্দে ভারী হয়ে যায়, আর এলাকার মুক্তি পাগল মানুষ গুলিও যার যা কিছু আছে তা নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। ঐ দিন সকালে পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধের সময় সাহায্য করতে গিয়ে মুরাদপুরের এক সদ্য বিবাহিত যুবক জানে আলম মাথায় পাকসেনার গুলির আঘাতে আহত হন। লোকজন তাঁকে ধরাধরি করে নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির একটি নির্মাণাধীন বাড়ির বারান্দায় নিয়ে এসে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তখন হাসপাতালে নেয়া বা এম্বুলেন্স ডাকার সুযোগ ছিলোনা। এই অবস্থায় নজরুল ইসলাম ও তাঁর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম তৎক্ষণাৎ অতি নিকটে অবস্থানকারী তাঁদের বাবা ডাঃ নূরুল হুদাকে নিয়ে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত জানে আলমকে আর বাঁচানো যায়নি এবং এক পর্যায়ে চিকিৎসাদেয়ারত ডাঃ হুদার সাহেব এর হাতেই শেষ নিঃস্বাশ ত্যাগ করেন।উল্লেখ্য যে, মাত্র তিন দিন আগে জানে আলম বিবাহ সম্পন্ন করেছিলেন এবং মৃত্যুর সময় তাঁর হাতের মেহেদির রং তখনও মুছে যায় নি| তখনকার সময়ে প্রায় বিয়েতে- বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকেই বিয়ে বাড়িতে গানবাজানো হতো উচ্চ শব্দের মাইকে, এটা ছিল একটা রেওয়াজ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র তিন দিন আগে অনুষ্ঠিত তাঁর বিয়ে উপলক্ষে সারাদিন বাজানো হয়েছিল সেই সময়কার জনপ্রিয় বাঙালির দেশাত্মবোধক জাগরণের গান। পরবর্তীতে মুরাদপুরের আমাদের( ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন) বাড়ির সংলগ্ন রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ জানে আলম সড়ক|
৭১ এর মার্চের শেষেরদিকে চট্টগ্রাম শহরের উপর পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণের কারণে নজরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম কয়েকদিন পর চলে যান বোয়ালখালী তাঁদের আদি বাড়িতে যেখানে পরিবারের সবাই ইতিমধ্যে শহর ছেড়ে চলে এসেছিলো। সেখানে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন তাঁরা, ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসের দিকে বোয়ালখালীর কধুরখীলে মুক্তি প্রিয় মানুষের উপর নিপীড়নকারী সশস্ত্র রাজাকারদের উপর বোমা হামলা করতে গিয়েছিলেন দুই দুঃসাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। দুজনেই তখন নবম বা দশম শ্রেণীর ছাত্র। একজন ছিলেন এখলাস, কধুরখীল হাই স্কুলে পড়তেন। আর একজন সাইফুল ইসলাম, শহরের রহমানিয়া হাই স্কুলে পড়তেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর শহরের ছেলে সাইফুল পরিবারের সাথে যুদ্ধের ঝুঁকিপূর্ণ শহর থেকে বোয়ালখালীতে চলে আসেন। এক পর্যায়ে এখলাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেন। দুইজনেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ঐ দিন নিক্ষেপকৃত বোমাটি রাজাকারদের উপর না পড়ে পাশের খালে পড়ে বিস্ফোরিত হয়।
এখলাস ওই ঘটনায় সাথে সাথে গ্রেপ্তার হয়ে যান রাজাকারদের হাতে। কিন্তু সাইফুলও প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিলো, তিনি ফুটবলার হওয়ায় কোন ভাবে দ্রুতগতিতে দৌঁড়ে গিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে রাজাকার ও পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচারে ঐ রাতেই শহীদ হয়েছিলেন এখলাস। স্বাধীনতার পরে বোয়ালখালীতে ইকবাল পার্কের নাম পরিবর্তন করে শহীদ এখলাস পার্ক রাখা হয়েছিলো। আর বোয়ালখালীর এয়াকুবদন্ডী এলাকায় একটি সড়কের নাম করণ হয়েছে তাঁর নামে।
সাইফুল ইসলাম, তাঁর পিতা চট্টগ্রামের প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা: নূরুল হুদা ও বড় ভাই নজরুল ইলাম ওরফে সৈয়দ হারুন নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করে ছিলেন।
তাঁর পিতা ডা: নূরুল হুদা চট্টগ্রামে মেডিকেল ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং পাক-ভারতের স্বাধীনতার পরে জেলা ছাত্রলীগের নেতা ও মেডিকেল স্টুডেন্ট লীগের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর পরিকল্পিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো তাঁকেও একজন চিকিৎসক হিসেবে হত্যার উদ্দেশ্যে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এক বার তাঁর মুরাদপুরের বাড়িতে পাকসেনা ও বিহারি রেফিউজি রাজাকাররা হানা দিলে তিনি দ্রুত পেছন দিয়ে সরে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে যান। এরপর তিনি বোয়ালখালীতে তাঁর কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন এবং এক পর্যায়ে তিনি সেখানেও টার্গেটে পড়ে যান পাকহানাদার এবং রাজাকারদের। যার কারনে তিনি আবারও বোয়ালখালী থেকেও সরে আসতে হয়েছিল চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই এলাকায় অবস্থান নেওয়ার জন্য। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দিন রাত সিকিৎসা সেবা ও নানাভাবে সহযোগীতা করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
মরহুম সাইফুল ইসলাম ইসলাম স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং তিনি সকল সভা এবং মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। এর আগে কিছু দিন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে কাজ করেছিলেন । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার খবর পেয়ে অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একটা বিষয় না বলা হলে অন্যায় হবে । সুগন্ধা আবাসিক এলাকা চট্টগ্রামের একটি অন্যতম দামী অভিজাত আবাসিক এলাকা। আবাসিক এলাকা হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতার আগে থেকেই এবং স্বাধীনতার পরবর্তী বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত এখানে শহরের আবর্জনা ফেলা হতো আর পুড়ানো হতো । এসবের দুর্গন্ধ পার্শ্ববর্তী এলাকার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, একসময় সহ্যের বাইরে চলে আসে । কিন্তু কারো কোন প্রতিবাদ নেই, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর কোনো দায়-দায়িত্ব বা সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই । এই প্রেক্ষিতে ১৯৭৫/৭৬ সালে সাইফুল ইসলাম এগিয়ে এসে তাঁর সাথী ও মুরাদপুরবাসীদের নিয়ে প্রতিবাদ এবং ট্রাক থেকে আবর্জনা ফেলতে বাধা প্রদান করতে থাকেন । একদিন বাধা দেওয়ার সময় তাঁকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে স্থানীয় জনসাধারণের প্রবল প্রতিবাদের মুখে সেটা ব্যর্থ হয়ে যায় । এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বাধ্য হয় ওই স্থানে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে । পরবর্তীতে এই এলাকাতেই একটি বিলাসবহুল আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে, যেটি এখন সুগন্ধা আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত । সাইফুল ইসলাম পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে ঐসময় সফল সংগ্রামটি করেছিলেন ।
বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়াসহ অনেকস্থানে তাঁকে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তাঁর স্মরণে চট্টগ্রাম শহরে ও বোয়ালখালীতে অনেকবার হয়েছে ফুটবল টুর্নামেন্ট। চট্টগ্রাম শহরের হামজারবাগ প্রাইমারি, নাসিরাবাদ সরকারি ও রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং সিটি কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। কিশোর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুলের কথা লিখতে গিয়ে সাইফুলের সাথে অনেক কিছু ঘটনা মিলিয়ে যাওয়া, ভারতের সর্ব কনিষ্ঠ বিপ্লবী ক্ষুদি রামের বীরত্বকাহিনি মনে পড়ে যায়, ক্ষদিরাম যেমন মাত্র ১৮ বছর বয়সে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজ মাতৃভূমিকে ভালবাসবে দেশকে স্বাধীন করার জন্য বিদ্রহী করেছিলেন, মেদিনীপুরের ইংরেজ বিচারক কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্যোশ্য ১৯০৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল, কিংসফোর্ড হত্যা করার জন্য গাড়ীতে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন, কিন্তু যেই গাড়ীতে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন সেই গাড়ীতে কিংসফোর্ড ছিলো না। কিংসলি ছিলো অন্য গাড়ীতে, ক্ষুদি রাম এবং প্রফুল্ল চাকি একসাথে বোমা নিক্ষেপ করার কারনে গাড়ীতে থাকা মিস কেনেডি ও কেনেডির মেয়ে সেই দিন মারা যান, প্রফুল্ল চাকি ঘটনা করে গ্রেফতার হওয়ার আগেই আত্মা হত্যা করলেও কিন্তু ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে যান, সেই অপরাধে কিশোর বিদ্রহী ক্ষুদি রামকে ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু দন্ড কার্যকর করেছিলেন। তখন ক্ষুদিরাম বসুর বয়স হয়েছিল ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন,ক্ষুদিরামকে ভারতের ইতিহাসে কনিষ্ঠ বিপ্লবী হিসেবে আখ্যাত করেছিলেন। ক্ষুদিরাম যে বয়সে শত্রুদের উপর বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন, তেমনি কিশোর সাইফুল ও সেই বয়সে পাক হানাদারদের দোসর রাজাকারদের উপর বন্ধু এখলাসকে নিয়ে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। ক্ষুদিরামের সাথে ছিলেন যে-মন প্রফুল্ল চাকি, তেমনি সাইফুলের সাথে ছিলো এখলাস। এখলাস ঘটনাস্থলে ধরা খেয়ে রাজাকারদের হাতে শহীদ হয়েছিল, সাইফুল দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। ক্ষুদিরাম যেমন কিশোর বিদ্রহী বিপ্লবী ছিলেন, তেমনি কিশোর সাইফুলও বিপ্লবী মনোভাবের ছিলেন। সাইফুলের বাড়ী বোয়ালখালী যে গ্রামে, সেই কধুরখীল গ্রামটিও ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদে আশ্রয় স্থান ছিলো,সাইফুল কধুরখীল স্কুলে কিছু দিন লেখা পড়া করেছিলেন সেই কধুরখীল স্কুলও বিপ্লবীদর অন্যতম স্থান। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস বোয়ালখালী তথা কধুরখীল স্কুলের কথা রয়েছে।আমাদের
বোয়ালখালী ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য জলপথের নাম,এই বোয়ালখালীতে সুফি সাধক,এবং বিভিন্ন ধর্মের মনিষীর জন্মের স্হান, এই বোয়ালখালী থেকেই ব্রিটিশ আন্দোলন হতে শুরু করে স্বাধীনতার যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, বোয়ালখালী একসময় শিক্ষা দীক্ষায়, ধর্মিয় আচার-আচরণে একটি অসাম্প্রদায়িকতার সুন্দর পরিবেশ বিরাজমান। এই বোয়ালখালীতে অসংখ্য গুনি জন জন্ম নিয়েছেন। বোয়ালখালী একদিকে পাহাড় অন্য দিকে নদী এবং দুইদিকে সমতল ভুমি রয়েছে, সেই বোয়ালখালীর কৃতি সন্তান ডাঃ নুরুল হুদা সাহেব এর গর্বিত সকল সন্তানের মধ্য থেকে অন্যতম বীরত্ব গাঁথা ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন যেই সন্তান, আমি সেই সন্তান সাইফুলের সাথে ক্ষুদিরামের মিল পাওয়ার কিছু উদাহরণ দেওয়া চেষ্টা করছি। ক্ষুদিরাম যেমন কিশোর বয়সে গরীব দুঃখী মানুষের পাশে থাকতেন এবং বিভিন্ন ত্রান বিলির কাজ করতেন, তেমনি সাইফুলও একইভাবে কাজ করতেন। সাইফুল আজ বেঁচে থাকলে তিনি দেশের একজন গর্বিত সন্তান হিসেবে পরিচিত লাভ করতেন, এই ধরনের “ব্যারিস্টার মনোয়ার এ-র বড় ভাই”