পরীক্ষায় পাস করার পরেও পরবর্তী শ্রেণিতে উঠতে আবার ভর্তি হতে হবে কেন? এ যেন শিক্ষাক্ষেত্রে এক অযৌক্তিক এবং অমানবিক প্রথা, যা আজকের দিনের শিক্ষার নামে রীতিমতো ‘চাঁদাবাজি’তে পরিণত হয়েছে। ‘সেশন ফি’, ‘উন্নয়ন ফি’, ‘বই কেনার চাপ’, কিংবা ‘বিভিন্ন উন্নয়নের নামে’ যে টাকা নেওয়া হয়, তা অভিভাবকদের জন্য বড় ধরনের আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ শিক্ষাকে দেশের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো—এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রকে গ্রাস করল কীভাবে? শিক্ষা শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, এটি জাতি গঠনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু আজকের দিনে সেই শিক্ষা আমাদের সমাজে একটি মুনাফাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। স্কুলগুলো এখন শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং কর্পোরেট কোম্পানির মতো আচরণ করছে। তারা শিক্ষার নামে টাকা আয়ের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছে। এ যেন এক কৌশলী চাঁদাবাজি, যা দিনের আলোয় লুটপাটের মতো আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে।
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ভর্তির নামে নতুন চাঁদা-
একজন শিক্ষার্থী যখন তার বর্তমান শ্রেণির পরীক্ষা পাস করে, তার পরবর্তী শ্রেণিতে যাওয়া একটি স্বাভাবিক এবং অধিকারভিত্তিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়াকে অযথা জটিল করে তোলে। পরবর্তী শ্রেণিতে উঠতে বাধ্যতামূলকভাবে ভর্তির ফি, সেশন ফি এবং নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় ফি চাপিয়ে দেওয়া হয়। একবার যে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, তাকে কেন আবার নতুন করে ভর্তির প্রয়োজন পড়বে?
তথাকথিত ‘উন্নয়ন ফি’র নামে প্রতি বছর অভিভাবকদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আদায় করা হচ্ছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নয়নমূলক কাজ চলতেই পারে, কিন্তু তার জন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের উপর এমন আর্থিক চাপ দেওয়া কতটা ন্যায়সংগত?
এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো—এই অর্থের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা। অনেক স্কুল এ ফি আদায় করে শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করা হয় না। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসরুমের পরিবেশ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কিংবা প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের মান বৃদ্ধির পরিবর্তে, সেই অর্থ ব্যবহৃত হয় অন্যত্র।
শিক্ষা কি আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করা নিঃসন্দেহে একটি নৈতিক সংকট। যেখানে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি এখনও প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, সেখানে বেসরকারি স্কুলগুলোর এই অতিরিক্ত ফি আদায় সাধারণ মানুষের জন্য আরও বড় অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করার পিছনে অভিভাবকদের যে প্রচেষ্টা এবং অর্থ ব্যয় হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যায়। এর ফলে অনেক প্রতিভাবান শিক্ষার্থী অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। একদিকে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, অন্যদিকে এই ধরনের চাঁদাবাজির মাধ্যমে সেই অধিকার হরণ করা হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ গড়ার বদলে মুনাফা অর্জনের দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। যে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হওয়ার কথা, তা আজ লভ্যাংশ নির্ভর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাব-
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, এই চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত প্রতিটি বেসরকারি স্কুল এবং কলেজের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা ফি আদায়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
বর্তমানে অভিভাবকদের অভিযোগ শোনার মতো কোনো কার্যকরী মঞ্চ নেই। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অভিভাবকদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে। সরকারের কাছে এই সংকট মোকাবিলার জন্য শক্তিশালী আইন এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আবেদন করা জরুরি।
এই সমস্যা সমাধানে আমাদের করণীয়
১. সরকারি হস্তক্ষেপ:
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত সেশন ফি এবং উন্নয়ন ফি নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা। কোন কোন ক্ষেত্রে ফি আদায় করা যাবে এবং তার সুনির্দিষ্ট ব্যবহার কী হবে, তা নির্ধারণ করা দরকার।
২. অভিভাবকদের সচেতনতা:
অভিভাবকদের উচিত তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া। অযৌক্তিক ফি আদায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং তাদের অভিযোগ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরা জরুরি।
৩. নিয়মিত অডিট:
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর আয়-ব্যয়ের অডিট বাধ্যতামূলক করা উচিত। এর মাধ্যমে অভিভাবকরা জানতে পারবেন, তাদের দেওয়া অর্থ কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
৪. প্রতিবাদ এবং প্রচারণা:
জাতীয়ভাবে এই ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং অভিভাবক কমিটি বা সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার নামে চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।
৫. বেসরকারি স্কুলের দায়িত্বশীলতা:
বেসরকারি স্কুলগুলোর পরিচালকদের নিজেদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত। তারা যেন ব্যবসার বদলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য—জাতি গঠনে মনোযোগ দেয়।
শেষ কথা: শিক্ষাকে ব্যবসায় নয়, সেবায় পরিণত করুন-
একটি জাতির উন্নতি নির্ভর করে তার শিক্ষার মানের উপর। যদি শিক্ষাক্ষেত্রে এই অন্যায় এবং চাঁদাবাজি চলতে থাকে, তাহলে তা দেশের ভবিষ্যৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। শিক্ষা কোনো পণ্য নয়; এটি একটি অধিকার।
আমাদের সন্তানদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে হলে এখনই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। সাধারণ মানুষের উচিত একসঙ্গে রুখে দাঁড়ানো। আমরা যদি সচেতন হই এবং সঠিক পদক্ষেপ নেই, তবে অবশ্যই শিক্ষাক্ষেত্রে এই অযৌক্তিক ফি আদায় বন্ধ করা সম্ভব হবে।
চলবে-