তালপাতার বাঁশি, সুরেলা সন্ধ্যা, আর এক অনাহূত ‘শিল্পী’!”
আমি—উকিল না হতে পারা, কোকিলও না!”
-মো. কামাল উদ্দিনঃ
“আমি উকিল হতে পারিনি, কোকিলও না!”—কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে পুরো মিলনায়তনে হাসির ঢেউ বয়ে গেল। শিল্পীরা মুচকি হেসে একে অপরের দিকে তাকালেন, আর সামনের সারিতে বসা অ্যাডভোকেট রেহেনা কবির রানু চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে এমন এক দৃষ্টি দিলেন, যেন সত্যি সত্যি উকিল হওয়ার সুযোগ নষ্ট করে ফেলেছি!
সন্ধ্যা তখন প্রায় শেষের পথে, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হলো, সংগীতের আসরে নয়—আমি যেন কোনো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রায় শুনতে যাচ্ছি! সন্ধ্যা প্রায় শেষের পথে, তালপাতার বাঁশির মোহময় সুরে আমরা সবাই ভেসে চলেছি এক অন্য জগতে। রিয়াজ ওয়ায়েজ আর হাসনা জান্নাত মিকাতের সুরেলা কণ্ঠে যেন মনটা একেবারে নরম তুলোর মতো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, এই সুরের জগতে ডুবে থাকি সারারাত। কিন্তু হঠাৎ করেই বাস্তবতা মাথার উপর হাতুড়ির বাড়ি মারল! ঘটনার আকস্মিকতা: কংকন দাসের ঘোষণায় অঘটন
ঠিক তখনই, অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা কংকন দাস তার মিষ্টি কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন—
“এবার আমাদের মাঝে রয়েছেন বিশেষ একজন অতিথি—কামাল ভাই! আমরা চাই, তিনি আমাদের অনুভূতি প্রকাশ করবেন!” কি সর্বনাশ! আমি তো নীরবে বসে ছিলাম, ভাবছিলাম, এই সুরেলা সন্ধ্যার এক ফোঁটা প্রশান্তি নিয়েই বাসায় ফিরে যাব। কিন্তু সে উপায় আর থাকল না।
আমি মঞ্চের দিকে হাঁটা দিলাম, মনে মনে ভাবছি, “এ জীবনে অনেক বিপদে পড়েছি, তবে এই বিপদ যেন আল্লাহও খাতায় লেখেননি!” হাততালির ঝড়: আমি যত মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, দর্শকদের হাততালি তত জোরে বাড়ছে। যেন হুট করে আমি জাতীয় পুরস্কার নিতে যাচ্ছি! আরেকটু এগোতেই হাজারেরও বেশি দর্শক চিৎকার করে উঠল—
“কামাল ভাই, গান চাই! গান চাই!”
গান গাওয়া না-গাওয়া নিয়ে মানসিক যুদ্ধ, আমার অবস্থা তখন শেয়ালের সামনে আটকে যাওয়া মুরগির মতো। এদিকে দর্শকের চাপে শরীরের সব রক্ত উপরে উঠে গিয়েছে—সেটা লজ্জার কারণে, না উত্তেজনায়, জানি না!
আমি তো নিশ্চিত, আমি যদি গান শুরু করি, দর্শকরা সংগীতানুষ্ঠান ছেড়ে ভাতের হোটেলের দিকে রওনা দেবে! আর শিল্পীরা? তাদের চোখে যে দুঃখ ভেসে উঠবে, তার জন্য অন্তত আমাকে তিনবার ক্ষমা চাইতে হবে। তাই প্রথমেই হাতজোড় করে বলে দিলাম— “আমি তো শিল্পী নই! আমি যদি গান গাই, তাহলে একে সংগীতসন্ধ্যা বলা যাবে না, বলা হবে ‘সংগীত-সংকট’!” কিন্তু এতেও কাজ হলো না। দর্শকরা এমনভাবে গাইগাই করছে, মনে হচ্ছে, গান না গেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে গেলে থানায় জিডি করেও পার পাব না! গানের চেষ্টা এবং অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া তখনই হঠাৎ আমার মাথায় একখানা বুদ্ধি এল। আমি দুঃখের সুরে বললাম— “আহারে! আমি জীবনে উকিল হতে পারিনি, কোকিলও হতে পারিনি!” দর্শকদের মধ্যে হাসির ঢেউ বয়ে গেল। কিন্তু তারা দমলেন না। আমি বাধ্য হয়ে দু’লাইন গেয়ে ফেললাম—
“আশার শ্রাবণ মানে নাতো মন,
ঝড় ঝড় ঝড়েছে তোমাকে আমার মনে পড়েছে।”
শীতের রাতে বর্ষার গান! দর্শকদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠল—
“কি মজা! কি মজা!”
এরপরই শুরু হলো হাততালির ঝড়। মনে হলো, দর্শকরা এইমাত্র ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছে! আমি নিশ্চিত, এই হাততালি আনন্দের জন্য না, বরং আশীর্বাদ যে আমি আর কোনো গান গাইছি না!
একটা পুরনো স্মৃতি ও আমার বর্তমান VIP স্ট্যাটাস অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল—একসময় আমরা সিনেমা হলে তৃতীয় শ্রেণির টিকিট কেটে সামনের সারিতে বসতাম। আমাদের ধারণা ছিল, সামনে বসলে নায়ক-নায়িকারা আমাদের গায়ে এসে পড়বে! কিন্তু দেখুন ভাগ্যের পরিহাস! আজ বিনা টিকিটেই একেবারে সামনের সারিতে VIP হয়ে বসেছি! তবে, আসল কারণ কিন্তু সম্মান নয়—আমি সামনের সারিতে বসেছি শুধু রিয়াজ ভাই আর মিকাতকে কাছ থেকে দেখার জন্য! শেষে মজার কিছু কথা ও বিদায় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা হলো, আমিও ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম। দর্শকদের একটু হাসানোর চেষ্টা করেছিলাম, মনে হলো, কিছুটা সফল হয়েছি। আর আমার গানের অভিজ্ঞতা? সেটা ছিল একেবারে “রোমহর্ষক!” তবে হ্যাঁ, আমি গান পাগল মানুষ। মাঝেমধ্যে শুনি, কখনো লিখিও। ভবিষ্যতে আরও কিছু গান লেখার ইচ্ছা আছে, তবে গাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত একটাই—
“গান গাওয়ার চেয়ে বরং হাততালি দিয়েই খুশি থাকব!”
তালপাতার বাঁশি—সুরের জাদুতে মোহময় এক সন্ধ্যা সুরের আবেশ, বাঁশির মায়াজাল, আর হৃদয়ছোঁয়া সংগীত—সব মিলিয়ে এক অনন্য সন্ধ্যা কাটালাম “তালপাতার বাঁশি” অনুষ্ঠানে। ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, চট্টগ্রামের থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত এই সংগীতসন্ধ্যা সত্যিই
এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। সুরের জাদুতে মোহিত এক রাত প্রাকৃতিক বাঁশির মৃদু সুর যখন মিলনায়তনে ছড়িয়ে পড়ল, তখন মনে হলো সময় থমকে গেছে। একুশে পদকপ্রাপ্ত কিংবদন্তি বংশীবাদক ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলামের সুর যেন আমাদের এক ভিন্ন জগতে নিয়ে গেল। উদ্বোধনী বক্তব্যে লোকগবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শেখ সাদী লোকসংগীতের ঐতিহ্য আর বাঁশির অনন্যতা নিয়ে আলোচনায় মুগ্ধ করলেন দর্শকদের।
সুরের রথে মুগ্ধতার যাত্রা রিয়াজ ওয়ায়েজ ও হাসনা জান্নাত মিকাতের কণ্ঠে একের পর এক গানের সুর ছড়িয়ে পড়ল মিলনায়তনের প্রতিটি কোণায়। বাংলার লোকজ সুর, শাস্ত্রীয় সংগীতের আবহ আর পুরনো দিনের হৃদয়ছোঁয়া গান—সবকিছু যেন এক অপূর্ব মেলবন্ধনে আমাদের নিয়ে গেল এক সুরেলা ভ্রমণে।
পুরনো দিনের গানগুলো শোনার সময় মনে হলো শৈশবের মেঠোপথে হাঁটছি, ভালোবাসার স্মৃতিগুলো নতুন করে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, কিংবা বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার আবেগ যেন আবার ফিরে আসছে। যখন বাঁশির মায়াবী সুর বেজে উঠল, মনে হলো রাতের নদীর বুকে জোছনার আলো ছড়িয়ে পড়েছে—এক অনির্বচনীয় অনুভূতি! এক সন্ধ্যার স্মৃতি, হৃদয়ে গেঁথে থাকা সুর
এই সংগীতসন্ধ্যায় শুধু গান নয়, অনুভূতিরও সুর বেজেছে। সুরের জগতে একবার প্রবেশ করলে আর ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না—এ কথার সত্যতা যেন আরও গভীরভাবে অনুভব করলাম।
সিআরএস টিভির আয়োজনে এমন অনবদ্য এক সন্ধ্যায় উপস্থিত থাকতে পেরে সত্যিই আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ। সুরের মোহনায় হারিয়ে যাওয়া এই রাত সংগীতপ্রেমীদের মনে দীর্ঘদিন গেঁথে থাকবে, ঠিক যেমন শীতের সকালে রোদের উষ্ণতা কিংবা বসন্তের বাতাসে দোল খাওয়া কিশোরীর ঘোমটা।
সংগীতের এই সোনালি জগতে ডুব দেওয়ার অপেক্ষায় রইলাম, যেখানে বাঁশির সুরের সঙ্গে আবারও মিশবে স্মৃতির আবেশ, ভালোবাসার অনুভূতি আর হারিয়ে যাওয়া দিনের মিষ্টি ব্যথা।
“-অনুষ্ঠান বিষয়ে বিস্তারিত লিখবো