চট্টগ্রাম ওয়াসা, নগরবাসীর পানি সরবরাহের প্রধান সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও, প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে চলছে দুর্নীতির গভীর শেকড়। আংশিক তথ্য সাংবাদিক এস এম পিন্টু থেকে পাওয়া- প্রতি বছর সিস্টেম লসের নামে শত কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, যা চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির বিল আদায়ের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, বিকাশের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন এবং পরিদর্শকদের স্বেচ্ছাচারিতা—সব মিলিয়ে ওয়াসার রাজস্ব ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
একটি প্রতিষ্ঠান যখন নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের নামে লুটপাট চালায়, তখন সেটি শুধু আর্থিক নয়, বরং নৈতিক দুর্বলতাও প্রকাশ করে। দুর্নীতির এই চক্র কেবল ওয়াসার পরিদর্শক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর শেকড় ছড়িয়ে আছে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও। চট্টগ্রাম ওয়াসার এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নগরবাসী আর দুর্নীতির এই বোঝা বইতে রাজি নয়। সঠিক নজরদারি এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ওয়াসার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, এই অব্যবস্থাপনার ধাক্কা
চট্টগ্রামবাসীকে বছরের পর বছর বয়ে বেড়াতে হবে। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানিবিক্রির আয়ের বিপুল অংশ বছরের পর বছর ধরে সিস্টেম লসের নামে লোপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর ওয়াসার রাজস্ব শাখার কিছু অসাধু পরিদর্শক ও কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রায় ১০০ কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাচ্ছে। বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়মিত ঘুষ আদায়ের জন্য বিকাশসহ বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে। কিভাবে চলে এই দুর্নীতির চক্র? ওয়াসার নিয়ম অনুযায়ী, গ্রাহকদের পানি ব্যবহারের বিল ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, কিছু পরিদর্শক গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত লেনদেন করেন এবং বিনিময়ে বিল কমিয়ে দেন। বিশেষ করে চান্দগাঁও এলাকার পরিদর্শক মো. নাছিরের বিরুদ্ধে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাহক জানান, “আমার পানির বিল অস্বাভাবিকভাবে বেশি দেখানো হচ্ছিল। পরিদর্শক নাছির বিকাশে টাকা পাঠানোর পরামর্শ দেন, বললেন এতে বিল কমে যাবে। টাকা না দিলে পরের মাসে আবার বেশি বিল আসবে।” একাধিক গ্রাহক এই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। বিকাশ লেনদেনের কিছু তথ্য প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, এই দুর্নীতি নিয়মিত চলমান। রাজস্ব আদায়ের হিসাব-নিকাশ
চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন গড়ে ৪৭.৫ কোটি লিটার (৪.৭৫ লাখ কিউব মিটার) পানি উৎপাদন ও সরবরাহ করে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ৩৭ টাকা প্রতি কিউব মিটারে বিক্রি হয়, যা থেকে দৈনিক আয় হয় ১৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা এবং বছরে ৬৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, আবাসিক গ্রাহকদের কাছে ১৮ টাকা প্রতি কিউব মিটারে বিক্রি করা হয়, যা থেকে দৈনিক আয় হয় ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং বছরে ২৮০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মোট বার্ষিক আয় হওয়ার কথা – ৩৪৫ কোটি টাকা। সিস্টেম লসের (১০%) পরও বার্ষিক আয় হওয়ার কথা – ৩১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
কিন্তু বাস্তবে মাসে মাত্র ১৯-২০ কোটি টাকা আদায় হচ্ছে, যা বছরে দাঁড়ায় ২৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৭৭ কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, যা সিস্টেম লসের নামে বর্ণনা করা হচ্ছে।
দুর্নীতির গভীর শেকড় সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম ফজলুল্লাহর সময় এই সিস্টেম লস ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছিল। গত ১৬ বছরে সিস্টেম লসের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওয়াসার প্রকৌশল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, “আমরা নগরবাসীর সেবা নিশ্চিত করতে রাত-দিন কাজ করছি। কিন্তু রাজস্ব শাখার কিছু অসৎ ব্যক্তি পুরো ব্যবস্থাটিকে কলুষিত করছে।” তারা আরও বলেন, “আমরা যদি ১০০ শতাংশ পানি উৎপাদন করতে পারি, তার মধ্যেও বড় একটা অংশ সিস্টেম লস দেখিয়ে লোপাট করা হয়। এই টাকা কোথায় যায় তা সবাই জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না।”
গ্রাহকদের দুর্ভোগ ওয়াসার অনিয়মের কারণে শেষ পর্যন্ত দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ গ্রাহকদের। নিয়মিত বিল পরিশোধ করলেও, অনেক সময় অস্বাভাবিক বিল আসে। আবার কিছু গ্রাহক কম বিল দিতে পারলেও, তার জন্য নির্দিষ্ট পরিদর্শককে নিয়মিত ঘুষ দিতে হয়। “আমি প্রতি মাসে নাছির ভাইকে বিকাশে ৫০০ টাকা পাঠাই। তিনি বলেছিলেন, এতে আমার বিল কম আসবে। সত্যিই তাই হয়েছে, কিন্তু আমি জানি এটা ঠিক নয়। তবু কিছু করার নেই।” বলেন চান্দগাঁও এলাকার এক গ্রাহক। ক্যাবের প্রতিক্রিয়া কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস.এম. নাজের হোসাইন বলেন,
“ফজলুল্লাহ চলে গেলেও তার অনুসারীরা এখনও আছে। তারা সিস্টেম লসের নামে পানি চুরি করে এবং জনগণের টাকা আত্মসাৎ করছে।” তিনি আরও বলেন, “ওয়াসার এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদলালেই হবে না, রাজস্ব শাখার অসৎ পরিদর্শকদেরও বিদায় দিতে হবে।” ওয়াসার অবস্থান
ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (সিআরও) রুমন দে বলেন, “ওয়াসা সরকারি সংস্থা, এখানে বিকাশ বা ক্যাশ লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।” তিনি আরও বলেন, “সিস্টেম লস কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আগে ৩৫ শতাংশ ছিল, এখন তা ২৫-৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। পানি সরবরাহ ঠিক থাকলে আয়ও বাড়বে।” দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ জরুরি
বিশ্লেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে – দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজস্ব শাখার পরিদর্শকদের কার্যক্রম মনিটরিং করতে হবে। নিয়মিত তদন্ত চালিয়ে ঘুষ নেওয়ার প্রমাণ পেলে তাদের বরখাস্ত করতে হবে।
সাধারণ গ্রাহকরা চান, ওয়াসার সেবা স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত হোক। তারা মনে করেন, প্রশাসনের সঠিক নজরদারি থাকলে এই দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। তা না হলে, চট্টগ্রামবাসীকে বছরের পর বছর এই অনিয়মের বোঝা টানতে হবে।চট্টগ্রাম ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এমডি পদে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, পানি চুরি, প্রকল্পসমূহ সময়মতো শেষ না করা এবং নথিপত্রে অসংগতি সহ বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী সাধারণ নাগরিক সমাজের বিক্ষোভে তার পদত্যাগসহ ১৭ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। তাদের অভিযোগের মধ্যে ছিল ভ্রমণ বিলকে ব্যবসায় পরিণত করা, অবৈধ সংযোগের তদন্তে গাফিলতি এবং সিস্টেম লসের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ।
অবশেষে, ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে এমডি পদ থেকে অপসারণ করে।
এই ঘটনাগুলো চট্টগ্রাম ওয়াসার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের দিকটি তুলে ধরে, যা ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
এ কে এম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে ২০০০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান এবং পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ওয়াসায় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তবে, এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয়নি এবং ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।তার দীর্ঘ ১৪ বছরের দায়িত্বকালীন সময়ে পানি চুরি, সিস্টেম লস, এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি, তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে পদে থাকার অভিযোগও রয়েছে।
অবশেষে, ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে এমডি পদ থেকে অপসারণ করা হয়