1. mail.bizindex@gmail.com : newsroom :
  2. info@www.bhorerawaj.com : দৈনিক ভোরের আওয়াজ :
শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ১০:৩৪ অপরাহ্ন
সর্বশেষ :
চট্টগ্রামের নাগরিক আন্দোলনের সাহসী যোদ্ধা মঈনউদ্দীন মহসিনের স্মরণে অশ্রুসিক্ত শোকসভা প্রবাসী সাংবাদিকতা য়সাইফুল ইসলাম তালুকদারকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান করলো প্রবাসী কর্ণফুলী ক্রীড়া পরিষদ কালিহাতীতে ১১ বছরের শিশুর বাল্যবিবাহ ইউএনওর হস্তক্ষেপে বন্ধ সাতক্ষীরায় ৭১ টেলিভিশনের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত চট্টগ্রামে এলএনজি সংকটে গ্যাস বিপর্যয়- আগাম প্রস্তুতির ঘাটতি প্রশ্নবিদ্ধ! হুমকি-ধমকির ছায়ায় কাটানো এক সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা–১ গণমানুষের সাহসী কণ্ঠের বিদায়: মঈনউদ্দীন মহসিনকে স্মরণ! ইরান-ফিলিস্তিনের প্রতিরোধে ইসরায়েলের পতনের ঘণ্টা বাজছে! বাকেরগঞ্জের ব্যবসায়ী মোঃ আমির হোসেন(মেকার) ইন্তেকাল করেছেন কেশবপুরে প্রকাশ্যে যুবদল কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা! সবুজসহ তিনজন আটক, এলাকায় উত্তেজনা!

গল্পে গল্পে জীবন কথা–৪

মো. কামাল উদ্দিন
  • প্রকাশিত: শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

“চরণদ্বীপের গল্প: কর্ণফুলীর তীরে আমার গ্রাম”

আমার প্রিয় গ্রাম বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ। জন্মের সুত্রপাত সেই গ্রামে, ঐতিহ্যবাহী নজর মোহাম্মদ বাড়িতে। মনে পড়ে, কোনও এক বৈশাখের সকালে যখন প্রকৃতি নতুন করে জেগে উঠছিল, তখনই আমি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখি। গ্রামটি যেন সবুজের চাদরে মোড়ানো এক টুকরো স্বর্গ, আর তার বুক চিরে বয়ে চলেছে কর্ণফুলী নদী। এই নদী আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গী, আবার কখনো কখনো তা হয়ে উঠেছে সর্বনাশা—আমাদের তিনটি বাড়ি কেড়ে নিয়ে গেছে তার উন্মত্ত স্রোতে। কর্ণফুলীর স্রোতে জীবন শৈশবে কর্ণফুলী ছিল আমাদের কাছে আশীর্বাদ আর অভিশাপের মিশ্রণ। বর্ষায় নদী ফুলে ফেঁপে উঠতো, আর সেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আমরা সাঁড়াশি হয়ে। কর্ণফুলীর স্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে শিখেছিলাম জীবনের প্রথম পাঠ—প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে বেঁচে থাকা। এই নদী কেবল জলধারা নয়, এটি আমাদের শৈশবের খেলার মাঠ, গ্রীষ্মের দুপুরের বিশ্রাম এবং বর্ষার সন্ধ্যার গল্পগাথার অনুষঙ্গ। নদীর ধারে বসে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতো, তা টেরও পেতাম না। কৃষি নির্ভর গ্রাম আমাদের গ্রামটি কৃষি নির্ভর। ধান, সবজি—সবকিছুর ছোঁয়া লেগেছিল আমাদের জীবনে। কৃষকদের ব্যস্ততা আর মাঠে মাঠে কৃষিকাজ ছিল আমাদের গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মনে পড়ে, বৈশাখের গরম দুপুরে যখন মাঠে ধানকাটা হতো, তখন ঘাম ঝরাতে ঝরাতে কৃষকেরা গান ধরতো। সেই গান ছিল প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সংযোগের প্রতিচ্ছবি। আমাদের সেই সময়ের কৃষি ফলন ছিল গ্রামের আত্মনির্ভরতার পরিচয়। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার স্মৃতি এখনও স্পষ্ট। শীতের রাতে চুপিসারে দলবেঁধে বের হতাম খেজুরের রস চুরি করতে। ঠান্ডা বাতাসে সেই রস যেন ছিল স্বর্গীয় এক পানীয়। আর সকালে পুকুরের ধারে বসে গাছের রস খাওয়ার আনন্দ ছিল বর্ণনাতীত।
বিদ্যালয়ের দিনগুলি আমাদের গ্রামের আব্বাসিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। ছোট্ট চারটি ক্লাসরুম ছিল পাশাপাশি, সেখানে বসেই আমরা শিক্ষার প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম। স্কুল মাঠে খেলার সময় কেউ একজন উঁচু গলায় ডাক দিয়ে বলতো, “চল মাঠে ফুটবল খেলা হবে!” তখন আর কোনো কিছুতেই মন বসতো না। বৃষ্টিতে ভিজে খেলা, আর স্কুলের বারান্দায় বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করা—এই সবই ছিল আমাদের ছেলেবেলার সোনালি মুহূর্ত।
খেলার মাঠ আর পুকুরে সাঁতার স্কুলের পাশেই ছিল বিশাল খেলার মাঠ। সেখানে বিকেলে দলবেঁধে ফুটবল আর দাড়িয়াবান্দা খেলতাম। গ্রামের পুকুরটিও আমাদের জন্য ছিল আরেকটি বড় খেলার জায়গা। সাঁতার প্রতিযোগিতা আয়োজন করতাম নিজেরাই, আর প্রতিযোগিতায় জেতা মানেই ছিল একদিনের জন্য “প্রধান সাঁতারু” হওয়া। পুকুরে নেমে কেউ মাছ ধরার চেষ্টা করত, কেউবা শুধু ঠাণ্ডা জলে ভেসে বেড়াতো। চরণদ্বীপের দরবার: আমাদের গ্রামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চরণদ্বীপ দরবার শরীফ। এই দরবার আমাদের গৌরবের প্রতীক। প্রতিবছর মাঘ মাসের ৭ তারিখে এখানে বসে বিশাল ওরশ, যা আমাদের গ্রামীণ জীবনে এক বিশাল উৎসবের মতো। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে, আর পুরো গ্রাম যেন মেতে ওঠে উৎসবের আমেজে। দরবারের পীর হযরত মওলানা অছিউর রহমান চরণদ্বীপি ছিলেন মাইজভান্ডার দরবারের প্রধান খলিফা। তাঁর জীবন, শিক্ষা ও দর্শন আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
সংস্কৃতি আর বিনোদন;
গ্রামের রাতের বিনোদন মানেই ছিল যাত্রাপালা। রাতের আঁধারে মাঠের মধ্যে বসে যাত্রার পালা দেখা ছিল অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। শীতের রাতে লেপ গায়ে দিয়ে দলবেঁধে যাত্রা দেখতে যেতাম। সেই রাতগুলো এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে।
গ্রামের ছেলেরা মিলে ক্লাব গঠন করেছিলাম ছোটবেলায়। সেই ক্লাবে আমরা নানান অনুষ্ঠান করতাম—বড়দের জন্য নাটক, ছোটদের জন্য খেলাধুলা। আমাদের ক্লাবই ছিল গ্রামের বিনোদনের কেন্দ্র। নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া স্মৃতি আমাদের বাড়ির তিনটি অংশই একসময় কর্ণফুলীর গ্রাসে চলে যায়। বাড়ির উঠোন থেকে নদীর ধারে তাকিয়ে দেখতাম, কিভাবে একের পর এক ঘর ভেঙে পড়ে নদীর জলে। তখন নদীকে অভিশাপ দিতে ইচ্ছা করতো, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হতো, এই নদীই তো আমাদের জীবনের অংশ। এখন কর্ণফুলী শান্ত, তবে তার বুকে আমাদের হারানো বাড়ির স্মৃতি আজও দোলা দেয়।
গ্রামের মসজিদ আর মাদ্রাসা গ্রামের মসজিদ আর মাদ্রাসা ছিল আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ছিল নিয়মিত অভ্যাস। আমরা মসজিদের কাজে স্বেচ্ছাশ্রম দিতাম, কেউ দেয়াল রং করত, কেউবা মাদ্রাসার ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতো।
চরণদ্বীপ আমার শেকড়। কর্ণফুলীর জলে যেমন আমার শৈশব ভেসে আছে, তেমনি গ্রামের মাটিতে লেগে আছে আমার প্রাণের ছোঁয়া। এখানে প্রকৃতি, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মিশ্রণ রয়েছে, যা সবসময় আমাকে টানে। জীবন যতই ব্যস্ত হোক, গ্রামের সেই সরল দিনগুলোর কথা কখনও ভুলতে পারবো না। চরণদ্বীপ শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি আমার অস্তিত্বের অপর নাম।
আমাদের বোয়ালখালী থেকে শহরে যাওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা আর সাম্পান। কর্ণফুলী নদী পেরিয়ে শহরে যেতে হতো, আর সেই যাত্রা ছিল আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। কর্ণফুলীর জলে ভোরবেলা সাম্পান ভাসিয়ে শহরের পথে রওনা হতাম, সন্ধ্যায় আবার নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে ফিরে আসতাম আপন গাঁয়ে। নদীর বুকে সাম্পানের বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছিল শৈশবের এক পরিচিত সুর।
তবে নৌপথের পাশাপাশি শহরে যাওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিল কালুরঘাট সেতু। ১৯৩০ সালে নির্মিত এই সেতু আমাদের বোয়ালখালীকে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করেছিল। ট্রেন আর পায়ে হাঁটার পাশাপাশি সাইকেল, রিকশা ও গাড়িও চলতো এই সেতুর উপর দিয়ে। কালুরঘাট সেতুর লোহার কাঠামোর উপর দিয়ে যখন ট্রেন চলতো, পুরো সেতু কেঁপে উঠতো, আর আমরা দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতাম। এই সেতু বোয়ালখালীর মানুষের জন্য ছিল এক আশীর্বাদ। আমাদের গ্রাম থেকে ধান, সবজি, আর অন্যান্য কৃষিপণ্য সহজেই শহরে পৌঁছানো যেতো কালুরঘাটের মাধ্যমে। বর্ষাকালে যখন কর্ণফুলী নদী উত্তাল হতো, তখন কালুরঘাট সেতুই ছিল শহরে যাওয়ার একমাত্র নিরাপদ মাধ্যম। কালুরঘাট সেতু আমাদের গ্রাম ও শহরের মধ্যে যে সংযোগ তৈরি করেছিল, তা আজও আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার গ্রাম বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি আমার আত্মার একটি অংশ। কর্ণফুলীর তীরে এই গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণায় আমার শৈশবের পদচিহ্ন লেগে আছে। এই গ্রামের প্রকৃতি, নদী, ফসলের মাঠ আর মানুষের সরলতা আমাকে বারবার টেনে আনে।
আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন চরণদ্বীপ হবে উন্নয়ন আর শান্তির প্রতীক। কর্ণফুলীর স্রোতের মতোই এই গ্রাম এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। কালুরঘাট সেতুর জায়গায় নতুন একটি আধুনিক সেতু হবে, যা আরও দৃঢ়ভাবে গ্রামকে শহরের সাথে যুক্ত করবে। কর্ণফুলীর দুই পাড়ে গড়ে উঠবে সবুজের সারি, যেখানে শিশুদের হাসি-খেলা ছড়িয়ে পড়বে বাতাসে। আমি স্বপ্ন দেখি, আমাদের আব্বাসিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আরও বড় হবে, সেখানে আধুনিক শিক্ষা উপকরণ থাকবে। গ্রামের প্রতিটি ছেলে-মেয়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে। চরণদ্বীপ দরবার শরীফের ওরশে আগত মানুষের ভিড়ে শুধু আধ্যাত্মিকতা নয়, এই মেলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে।
আমার গ্রামের প্রতিটি সাম্পান, প্রতিটি খেজুর গাছ আর ধানক্ষেত যেন বহন করে চলে সেই ঐতিহ্য, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ধরে এগিয়ে যাবে। আমি চাই, কর্ণফুলীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যারা সূর্যাস্ত দেখে, তারা যেন জানে—এই গ্রাম শুধু প্রকৃতির নয়, এটি ভালোবাসা আর সংস্কৃতির এক মূর্ত প্রতীক। আমার স্বপ্নের চরণদ্বীপ হবে শান্তি, ঐতিহ্য আর উন্নয়নের এক অপরূপ গ্রাম, যা কর্ণফুলীর স্রোতের মতো চিরকাল বহমান থাকবে আমাদের হৃদয়ে।
চলবে—

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০৩১  
© সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট