প্রতিদিনের মতোই সেদিন সকালটা শুরু হলো ভোরের আলো ফুটতেই। বাটালি হিলের শতায়ু অঙ্গন আমার পায়ের নিচে ছিল যেন পাহাড়ি মেঘের মতো এক কোমল অনুভূতি। সেখানেই পরিচয় হলো সাবাহ মাহিরা আর নাজিফা সানার সঙ্গে। তরুণ বয়সের এক অনাবিল উদ্যম আর হাসির মুগ্ধতায় ভরা এই দুই কিশোরী যেন পাহাড়ি ঢেউয়ের মতো অদম্য। সাবাহ মাহিরা আর নাজিফা সানা—দুজনের মধ্যেই ছিল জীবনের নানা রঙ। সাবাহ মাহিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তবে তার জীবনের গল্পটা কেবল বইপড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছে এই তরুণীর কাঁধে। ছোট ভাইবোনদের দেখভাল করে, রান্না করে, মায়ের পাশে বসে তার ব্যথার সঙ্গী হয়। এমনকি নিজের পড়াশোনার মাঝেও সময় বের করে সংসারের সবকিছু ঠিক রাখার চেষ্টা করে। সাবাহর মুখের হাসি আর চোখের গভীরতা বলে দেয়, জীবন তাকে কম বয়সেই দায়িত্ববোধের পাঠ পড়িয়েছে। অপরদিকে, নাজিফা সানা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায়। সে তার বোনদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসে। পড়াশোনায় মনোযোগী এই তরুণী নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু স্বপ্নগুলো যেন খুব সাধারণ, বিনয়ী। পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, “জীবনে বড় কিছু হতে হবে, সেটা বড় কথা নয়; ভালো মানুষ হওয়াটাই আসল।” তার এই সাদামাটা ভাবনার পেছনে লুকিয়ে থাকা গভীরতা আমাকে অভিভূত করল। সকালের আলাপচারিতা তাদের সঙ্গে আলাপ শুরু হলো একেবারে সাধারণ কথাবার্তা দিয়ে। প্রথমে কিছুটা দূরত্ব রাখলেও পরিচয় দেওয়ার পর তারা বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। জীবনের নানা বিষয়, তাদের পরিবার, পড়াশোনা, আর আগ্রহগুলো নিয়ে তারা কথা বলল। সাবাহ বলল, “মায়ের শরীর খারাপ দেখে মনে হয়, কখনো কখনো নিজেই কিছু করতে পারতাম যদি!” অন্যদিকে, নাজিফা হেসে বলল, “আমরা বোনেরা মিলে প্রায়ই গল্প করি, কিন্তু আমার একটাই আফসোস—বই পড়ার অভ্যাসটা তৈরি হয়নি।” তাদের কথায় প্রাণ খুঁজে পেলাম। তারা ঘুরতে ভালোবাসে, নতুন জায়গা আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু এই প্রজন্মের একটি সাধারণ সমস্যা তাদের মধ্যেও রয়েছে—মোবাইল আসক্তি। ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলে সময় কাটায় তারা। অথচ প্রকৃতি এত সুন্দর, এ বিষয়ে তাদের একটু উদাসীনতা দেখলাম।
প্রকৃতির মাঝে তাদের বিচরণ যতক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা হলো, ততক্ষণ মনে হলো যেন প্রকৃতি আর মানবমনের এক অপূর্ব মেলবন্ধন দেখছি। শতায়ু অঙ্গনের সবুজে মোড়া পরিবেশে তারা একেকটি উড়ন্ত পাখি, যার ডানা মেলে আছে স্বপ্ন আর সম্ভাবনার দিকে। তাদের হাসিতে প্রাণ ছিল, কথায় ছিল সততা। তারা এমনভাবে কথা বলছিল যেন চেনা মানুষ আমরা বহুদিনের। সাবাহ আর নাজিফার কথার মাঝে তাদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন এক সুতোয় গাঁথা। সাবাহর দায়িত্বপূর্ণ আচরণ আর নাজিফার উচ্ছলতা যেন দুটি বিপরীতধর্মী অথচ সমান গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের মিশেল।
ছবি তোলা আর বিদায়ের মূহূর্ত আলোচনার এক ফাঁকে তারা আমার সঙ্গে ছবি তুলল। সেই মুহূর্তগুলো ছিল আনন্দময়। তাদের হাসিমাখা মুখ দেখে মনে হলো, এভাবেই তারা জীবনের কঠিন সময়গুলোও সামলে নেবে। বিদায়ের সময় নাজিফা বলল, “আবার দেখা হবে, তাই না?” আর সাবাহর চোখে ছিল কৃতজ্ঞতার এক চিলতে আভা। সাবাহ মাহিরা আর নাজিফা সানা—এই দুই উঠন্ত পাখি তাদের ডানায় ভর করে উড়তে চায়। জীবনের ছোট ছোট দায়িত্ব, চ্যালেঞ্জ, আর স্বপ্নের পথে তারা এগিয়ে চলেছে। তাদের সহজ-সরল জীবন, বিনয়, আর আন্তরিকতাকে দেখে মনে হলো, সত্যিকারের জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে হলে এমনটাই হতে হয়। এই সকালে তাদের সঙ্গে পরিচয় আমার মনকে শুদ্ধ করল। তাদের জীবনের গল্প, স্বপ্ন, আর হাসি আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। বাটালি হিলের সবুজ পরিবেশে তাদের বিচরণ আমাকে মনে করিয়ে দিল, জীবন যত কঠিনই হোক, তার মাঝে আনন্দ আর সৌন্দর্য খুঁজে নিতে জানতে হয়।
লেখার ভাবনা: তরুণ প্রজন্মের দায়বদ্ধতা ও স্বপ্নপথ লেখক হিসেবে প্রতিদিনের জীবনে নানান মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। তবে কিছু মানুষ থেকে যায় আলাদা, যারা তাদের হাসি, কথার গভীরতা, কিংবা জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মনে দাগ কাটে। সাবাহ মাহিরা ও নাজিফা সানা তেমনই দুই তরুণী, যাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে বাটালি হিলের শতায়ু অঙ্গনে। তাদের উচ্ছ্বাস, দায়িত্ববোধ, এবং জীবনের প্রতি তাদের সজাগ মনোভাব আমাকে ভাবিয়েছে গভীরভাবে। তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ আজ প্রযুক্তির আসক্তিতে ডুবে যাচ্ছে, অথচ তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। সাবাহ আর নাজিফার মতো তরুণীরা নিজেদের জীবনের সংগ্রাম আর স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে নিরলস পরিশ্রম করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় উপলব্ধি করলাম, পারিবারিক দায়িত্ব পালন আর পড়াশোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কীভাবে তারা ব্যালান্স করছে। আমাদের সমাজে নারীদের জন্য জীবন পথ বরাবরই কঠিন। কিন্তু এই দুই তরুণীর মধ্যে আমি দেখেছি এক অদম্য আত্মবিশ্বাস। তারা জানে, জীবনের যে দায়িত্ব তাদের কাঁধে এসে পড়েছে, সেটি তাদের শক্তি হিসেবেই কাজ করবে। এই লেখার ভাবনা মূলত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা, সম্ভাবনা, এবং তাদের দৈনন্দিন সংগ্রামকে তুলে ধরার। পাশাপাশি, তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সংযোগের গুরুত্বও এখানে তুলে ধরেছি। লেখকের দায়িত্ব কেবল বাস্তবতার গল্প বলা নয়, বরং সেই গল্পের ভেতর থেকে পাঠকের মনে আশা আর অনুপ্রেরণার সঞ্চার করা। সাবাহ আর নাজিফার জীবনের গল্প আমাদের শেখায় যে দায়িত্ববোধ আর স্বপ্নের মিশেলে কীভাবে জীবনের অন্ধকার দূর করা যায়। তাদের এই যাত্রার সঙ্গী হয়ে লেখার মধ্যে দিয়ে আমি খুঁজে পেয়েছি নতুন উদ্যম, যা লেখকের মনোভাবের গভীরে গিয়ে তাদের মতো তরুণদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।
-লেখক, সাংবাদিক, কথা সাহিত্যিক, গবেষক ও
টেলিভিশন উপস্থাপক,