এই ছবিটি আমাকে এক গভীর প্রতীকের দিকে নিয়ে যায়। একজন নারী, তার হাতে সুঁই-সুতার কাজ, আর সামরিক পোশাকের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা এক যোদ্ধা সত্তা। তিনি বসে আছেন এক লাল চেয়ারে, হাতে সুঁই দিয়ে তার ক্ষত সেলাই করছেন। যেন তার বিয়ের সাজপোশাক আর যোদ্ধার পোশাক একে অপরকে প্রতীকীভাবে জড়িয়ে রেখেছে। যুদ্ধের রক্তাক্ত দাগ মুছে দেওয়ার জন্য তিনি নিজেই সেলাই করছেন নিজের ক্ষত, যেন যুদ্ধে জয়লাভের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন। অস্ত্র তার পাশে রাখা, কিন্তু সেই মুহূর্তে শান্তি আর পুনর্গঠনের প্রতীক হয়ে ওঠা সুঁই-সুতার কাজই তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। এই নারীর মুখে কোনো ক্লান্তি নেই, বরং এক দৃঢ় সংকল্প। ফুলের বাগান তার পিছনের পটভূমিতে থাকা সত্ত্বেও, যেন তা তার শান্তি আর সংগ্রামের দ্বৈততার প্রতিনিধিত্ব করছে। তার মাথার ওপরের ফুলমুকুট তার বিয়ের প্রতীক হতে পারে, কিন্তু তার শক্তিশালী পোশাক ও সামরিক জুতা প্রমাণ করে যে তিনি একজন যোদ্ধা, একজন প্রতিরোধের প্রতীক। এই দৃশ্য তার ব্যক্তিত্বের দুটি দিক তুলে ধরে—নারীত্বের কোমলতা এবং যোদ্ধার শক্তি।
সৃষ্টিশীলতার প্রতীক হিসাবে এই সেলাই করা দৃশ্যটি দেখায়, কীভাবে যুদ্ধের ক্ষতকে মেরামত করে নতুন করে তৈরি হতে হয়। যেন প্রতিটি সেলাই একটি প্রতিজ্ঞা, এক একটি ক্ষত পুনর্জীবনের চিহ্ন। তার এই কাজ পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়, যে ক্ষত থাকলেও তাকে থামানো যাবে না, সে লড়ে যাবে। শান্তির জন্য যুদ্ধ করে যাবে, আর যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হলেও নিজের জীবনকে পুনর্গঠন করবে সুঁই-সুতার মতো নিরব এবং নির্ভীকভাবে। এই চিত্রকর্মে নারীর মনোবল আর সংকল্পের এক নিঃশব্দ শক্তির গল্প আছে, যেখানে সুঁই হয়ে ওঠে তার অস্ত্র এবং সেলাইয়ের প্রতিটি দাগ হয়ে ওঠে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সেবিকা রিপা—এক সাহসী ও প্রতিবাদী মনের নারীর প্রতীক, যিনি প্রতিদিন জীবনের সংগ্রামে নিজের অবস্থান দৃঢ় করে এগিয়ে চলেছেন। তিনি কোনো সাধারণ সেবিকা নন; তার সেবার চাদরের নিচে লুকিয়ে থাকা এক যোদ্ধার হৃদয়। সম্প্রতি, রিপা একটি ছবি পোস্ট করেছেন, যে ছবিটি তার নিজস্ব জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। এই ছবির সাথে তার প্রতিবাদী মনোভাবের এক গভীর সংযোগ রয়েছে—যেন এক নারীর সেবার মাঝে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা এক যোদ্ধা।
রিপার জীবনও যেন সেই ছবির নারীর মতো। তিনি বাইরে থেকে যতই স্নেহময়ী, যত্নশীল ও কোমল হোন না কেন, তার হৃদয়ে জ্বলে ওঠা এক প্রতিবাদের অগ্নি রয়েছে। প্রতিদিন তিনি হাসপাতালে রোগীদের সেবা করেন, তাদের সুস্থ করে তোলার জন্য নিজের যত্ন আর ভালোবাসার মন্ত্র ব্যবহার করেন। কিন্তু তার প্রতিদিনের জীবনের সংগ্রাম এক অন্যরকম যুদ্ধের গল্প বলে। এই যুদ্ধটি শুধু রোগের বিরুদ্ধে নয়, বরং হাসপাতালের অভ্যন্তরে থাকা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তার সেবা দেওয়ার আড়ালে, রিপা যে প্রতিবাদী মনোভাব লালন করেন, তা হাসপাতালের অভ্যন্তরে চলমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সুপ্ত যুদ্ধ। তার সাহসী মন সব সময় তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রেরণা দেয়। এই যুদ্ধ কেবল ব্যক্তিগত বা পেশাগত নয়, এটি এক ন্যায়ের পথে চলা সংগ্রাম। একদিকে, সুঁই আর সুতার মতো ধৈর্যের মাধ্যমে তিনি রোগীদের ক্ষত সেলাই করেন, অন্যদিকে, তিনি সংগ্রাম করে যান দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নিজেকে নির্ভীক যোদ্ধার মতো গড়ে তুলেছেন। এই ছবির নারীর মতোই, রিপা নিজের ক্ষতগুলোও সেলাই করেন—তবে তার ক্ষত হলো এক কঠিন বাস্তবতা, যেখানে মানবিকতা এবং সেবার নীতি বারবার আক্রান্ত হয়েছে। তিনি নিজের ক্ষতগুলো মেরামত করেন, নিজের আত্মাকে শক্তিশালী করে তোলেন, যাতে তিনি আরও সাহসীভাবে দাঁড়াতে পারেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
রিপার হাতে সুঁই থাকলেও, পাশে রাখা আছে প্রতিবাদের শক্তিশালী অস্ত্র। হাসপাতালের অবিচার আর অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি তার শক্ত অবস্থান নিয়েছেন, যেন তিনি ঘোষণা দিচ্ছেন—”আমি শুধু সেবিকা নই, আমি প্রতিবাদী, আমি সংগ্রামী।” এই প্রতিবাদি সেবিকা রিপাকে আমরা স্বাগতম জানাই। তার হৃদয়ে যে সাহসের অগ্নি জ্বলছে, তা আমাদের সবাইকে প্রেরণা জোগায়। আমাদের স্বপ্নের এক সুন্দর, ন্যায়ভিত্তিক হাসপাতাল এবং সমাজ গঠনের পথে তিনি এক নিরলস যোদ্ধা। তার গল্প আমাদের দেখায়, কীভাবে একজন সেবিকার কোমলতা আর একজন যোদ্ধার শক্তি একইসঙ্গে বেঁচে থাকে।