ইতিহাসে অনেক রাজার কথা শুনেছি—সম্রাট আকবর থেকে শুরু করে মুঘল রাজা-বাদশাহ, এমনকি আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক নেতারাও রাজার মতোই আচরণ করেছেন। তবে আজ যে রাজার গল্প বলতে বলবো, তিনি কোনও রাজপরিবারের সন্তান নন, কোনও ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের অধিপতি নন। তিনি গাছ রাজা থেকে শুরু করে বালুর রাজা, এবং ধীরে ধীরে একজন মহারাজা হয়ে উঠেছেন। তার ক্ষমতার উৎস রাজনীতিতে, শোষণ ও দুর্নীতিতে, যার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বাংলাদেশের বিগত সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তিনি বোয়ালখালী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাজা মিয়া, এক দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক ও চাটুকার, যার পিছনে রয়েছে হাসান মাহমুদের অপরিসীম রাজনৈতিক প্রভাব।গাছের রাজত্ব রাজা মিয়ার উত্থান শুরু হয় আশির দশকে। সেই সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অবৈধভাবে সেগুন গাছ চোরাচালানের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন। কর্ণফুলী নদীর পথে সেগুন গাছ চোরাচালান করে তিনি পরিচিতি পান ‘গাছের রাজা’ নামে। গাছের ব্যবসা পরিচালনার জন্য তিনি চট্টগ্রাম শহরের বাদুরতলা এলাকায় একটি রাজ ফার্নিচারের দোকান খোলেন এবং একটি কাঠ ফারাই করার স’মিল স্থাপন করেন। তার কাঠ চোরাচালানের ব্যবসা এতটাই সুসংগঠিত ছিল যে, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পর্যন্ত তার সাথে যুক্ত ছিলেন, এবং তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ কর্ণফুলী নদী দিয়ে গাছ পরিবহন করতে পারতো না।
গাছের কাঁচা টাকার অংশ পেত প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও। এভাবে তিনি গাছ ব্যবসার মাধ্যমে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তবে সময়ের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের গাছের উৎস ফুরিয়ে আসায় তার গাছের সাম্রাজ্য পতনের মুখে পড়ে। এই পতনের পর তিনি নতুন করে শুরু করেন আরেকটি ব্যবসা—বালুর ব্যবসা।বালুর সাম্রাজ্য
গাছের ব্যবসার মতোই, বালুর ব্যবসায়ও রাজা মিয়া নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ণফুলী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে তিনি তার ব্যবসা শুরু করেন। এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ‘কামাল মেম্বার’ নামে পরিচিত একজন নিহত হন, যার ফলে কর্ণফুলী নদীতে বালুর অবৈধ উত্তোলনের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে রাজা মিয়ার হাতে চলে আসে। তার সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, কর্ণফুলী নদীর আশেপাশে কেউ তার অনুমতি ছাড়া বালুর ব্যবসা করতে পারতো না। কর্ণফুলী নদী থেকে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে তিনি শত শত কোটি টাকা আয় করেন। হাসান মাহমুদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে তিনি সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের বালু সরবরাহের কাজও হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে বালু ভরাটের কাজ ছিল উল্লেখযোগ্য। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করেন, যদিও সেই বালু সরবরাহের জন্য সরকার থেকে কোনও বৈধ টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। পুরো প্রক্রিয়া ছিল একটি অবৈধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালিত।
হাসান মাহমুদের সাথে সখ্যতা রাজা মিয়ার ক্ষমতার উৎস ছিল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ড. হাসান মাহমুদ। হাসান মাহমুদের হাত ধরেই রাজা মিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে প্রতিষ্ঠা পান। হাসান মাহমুদের রাজনৈতিক সহায়তায় তিনি বোয়ালখালী উপজেলায় তার আধিপত্য কায়েম করেন এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের পদে নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই পদগুলো তার জন্য ক্ষমতা এবং সম্পদের উৎস হয়ে ওঠে।
হাসান মাহমুদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল এতটাই গভীর যে, রাজা মিয়া বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নকে রাঙুনিয়ার সাথে যুক্ত করার সময় বোয়ালখালীবাসীর সাথে বেঈমানী করেন। এই সংযুক্তি বোয়ালখালীকে একক সংসদীয় আসন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করে, এবং রাজা মিয়া হাসান মাহমুদের প্রতি চাটুকারিতা করে তার দখলদারি রাজনীতি আরো সুসংগঠিত করেন।
দুর্নীতি ও অপকর্ম রাজা মিয়ার দুর্নীতি এবং অপকর্মের জাল ছড়িয়ে ছিল বোয়ালখালী থেকে শুরু করে পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে। কর্ণফুলী নদী থেকে বালু উত্তোলনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি এবং তার সহযোগীরা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। এই সিন্ডিকেটের শীর্ষে ছিলেন রেজাউল করিম চৌধুরী এবং আরও অনেক প্রভাবশালী নেতা, যারা সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতেন। রাজা মিয়ার এই অবৈধ কার্যকলাপের মাধ্যমে তিনি শুধু বালুর রাজা নন, হয়ে উঠেছেন এক মহারাজা। তাছাড়া, তার বিরুদ্ধে আরও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে—ওয়াসার কাজ থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রকল্পগুলোর কাজের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, যদিও তার প্রভাবের কারণে এখনও পর্যন্ত তাকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি। হাসান মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজত্ব
রাজা মিয়ার ক্ষমতা এবং আধিপত্যের পিছনে সবসময় ছিল হাসান মাহমুদের ছায়া। হাসান মাহমুদের প্রভাবে তিনি বোয়ালখালী উপজেলায় রাজত্ব কায়েম করেন এবং বালুর ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে বিশাল সম্পদের মালিক হন। তবে হাসান মাহমুদ এখন রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা এবং পলাতক। রাজা মিয়াও একসময় তার পতনের সম্মুখীন হতে পারে, কারণ তার অপরাধের জাল এতটাই গভীর যে, তা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। আরো বিস্তারিত পর্যালেচনা করলে দেখা যায় –
ইতিহাস সাক্ষী, অনেক সময় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অপরাধের মাধ্যমে সমাজের কিছু মানুষ অসাধারণ প্রতাপ এবং প্রতিপত্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই ধারা লক্ষণীয়, যেখানে অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা, অবৈধ কার্যক্রম, এবং ক্ষমতার অযৌক্তিক ব্যবহারই হয়ে উঠেছে সাফল্যের মাপকাঠি। রেজাউল করিম রাজা মিয়ার উত্থান এমনই এক ক্ষমতার কাহিনি, যার মাধ্যমে বোঝা যায়, রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব এবং স্বার্থপরতা কিভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির পথ প্রশস্ত করে। গাছের রাজা: প্রশাসনের অন্ধকার সহায়তা রাজা মিয়া, যিনি প্রথমে চোরা গাছের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন, সেখানে তিনি শুধু একজন সাধারণ ব্যবসায়ী নন, বরং প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক সহযোগিতায় নিজেকে একটি চোরা কারবারি সাম্রাজ্যের রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার গাছ চোরাচালান এতটাই সুসংগঠিত ছিল যে, কর্ণফুলী নদী হয়ে তার গাছ পরিবহনের সময়ে প্রশাসনসহ স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও তার কাজে সহায়তা করতো। প্রশাসনের এই অন্ধকার পক্ষের সহায়তায় রাজা মিয়া সেই সময়ের প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠেন।
এই ঘটনাগুলো আমাদের সমাজের সেই গভীর সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে প্রশাসনের সাথে চোরাচালান এবং দুর্নীতির সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তা সমাজের প্রকৃত উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দুর্নীতির জাল শুধু অপরাধীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়, যার ফলশ্রুতিতে সুশাসনের ধারণা ম্লান হয়ে যায়।
বালুর রাজা: রাজনৈতিক প্রভাব এবং হত্যা
গাছের ব্যবসায় যখন ভাটা পড়ে, তখন রাজা মিয়া তার নতুন উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বালুর ব্যবসা শুরু করেন। কর্ণফুলী নদীতে বালুর অবৈধ উত্তোলন থেকে শুরু করে, কামাল মেম্বারের হত্যার মতো মারাত্মক ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা কেবল অর্থের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা মানুষের জীবনের জন্যও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজা মিয়ার বালুর সিন্ডিকেট কেবল অর্থনৈতিক প্রভাবই বিস্তার করেনি, বরং তা সহিংসতার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। এই হত্যার ঘটনাগুলি রাজনীতির আরেকটি অন্ধকার দিক তুলে ধরে, যেখানে ব্যবসার প্রতিযোগিতা এবং প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে জীবন হারাতে হয় সাধারণ মানুষকে। রাজা মিয়া যে এই ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছেন, তার পেছনে রয়েছে হাসান মাহমুদের রাজনৈতিক ছত্রছায়া। ক্ষমতার অপব্যবহার কিভাবে হত্যা, সহিংসতা, এবং শোষণকে বৈধতা দেয়, এই ঘটনা তার প্রমাণ।
হাসান মাহমুদের ছায়ায় শাসন
হাসান মাহমুদের সাথে রাজা মিয়ার সম্পর্ক শুধু একটি রাজনৈতিক সখ্যতা নয়, বরং তা একটি চাটুকারিতার দৃষ্টান্ত। হাসান মাহমুদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাজা মিয়া বোয়ালখালীতে তার রাজত্ব কায়েম করেন। এই ধরনের চাটুকারিতা এবং রাজনৈতিক তোষামোদ বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বড় সংকট। একজন নেতা যখন তার সহকর্মীদের দুর্নীতি, অবৈধ কার্যক্রম, এবং শোষণকে বৈধতা দেন, তখন তা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতীয় পর্যায়ের সমস্যা হয়ে ওঠে। এখানে আমাদের দেখতে হয় যে, রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনসেবা হলেও, বাস্তবে তা অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যমে বিকৃত হয়ে যায়। রাজা মিয়ার উত্থান এবং হাসান মাহমুদের রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সৎ এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাব কতটা প্রকট।
দুর্নীতি ও অপকর্মের পরিণতি রাজা মিয়ার বিরুদ্ধে বালু ব্যবসা এবং অন্যান্য কাজের মাধ্যমে দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত তিনি কোনও আইনি প্রতিকার বা বিচারের সম্মুখীন হননি। তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রশাসনের কিছু অংশের সহযোগিতা তাকে অপরাধের জগতে নির্বিঘ্নে চলতে দিয়েছে। এর ফলে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব এবং অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
এই ঘটনাগুলি আমাদের সমাজের গভীর সংকটকে প্রতিফলিত করে, যেখানে দুর্নীতি, চাটুকারিতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার সাধারণ মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একদিকে রাজা মিয়ার মতো লোকেরা অপ্রতিরোধ্যভাবে ক্ষমতার উচ্চ শিখরে আরোহন করছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিফলন ও দায়িত্ববোধ থেকে যদিবলি-এই রাজার রাজত্ব কেবল তার ব্যক্তিগত উত্থানের গল্প নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক সমস্যা—দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে কিভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অপরাধের শিকড় গেড়ে বসে তা স্পষ্ট করে তোলে। আজকের রাজনীতি এবং সমাজ ব্যবস্থায় সৎ, দায়িত্বশীল নেতৃত্বের অভাব আমাদের ভবিষ্যতের জন্য গভীর শঙ্কার জন্ম দেয়। আমাদের এখন জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন রাজনীতিতে স্বচ্ছতা এবং নৈতিকতার। জনসেবার নামে যারা শোষণ এবং দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুষ্ঠু এবং সুশৃঙ্খল সমাজ উপহার দিতে হলে এখনই দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
লেখকঃ গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান- দৈনিক ভোরের আওয়াজ, The Daily banner –
–চলবে…