
১৬ই ডিসেম্বর—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এই দিনটি শুধু একটি তারিখ নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা ও আত্মত্যাগের চূড়ান্ত স্বীকৃতি। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল বহু কাঙ্ক্ষিত বিজয়। লাল-সবুজের পতাকা উড়েছিল স্বাধীন দেশের আকাশে, বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ।
এই বিজয় এসেছে সহজে নয়। এসেছে লাখো শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে, অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনার মধ্য দিয়ে, কোটি মানুষের উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা, গণহত্যা ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাতে অস্ত্র নিয়ে যেমন যুদ্ধ করেছে, তেমনি কলম, কণ্ঠ ও বিবেক দিয়েও চালিয়েছে প্রতিরোধ।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়; এটি ছিল শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির সর্বাত্মক বিদ্রোহ। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, নারী-পুরুষ—সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে একটাই স্বপ্ন দেখেছিল: স্বাধীন বাংলাদেশ। এই ঐক্যই আমাদের বিজয়ের প্রধান শক্তি, যা আজও জাতির সবচেয়ে বড় প্রেরণা।
বিজয়ের ৫৪ বছরে দাঁড়িয়ে আজ বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বিজয় দিবস আমাদের শুধু অর্জনের হিসাব করতে শেখায় না; বরং আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়। আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা—ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও বৈষম্যহীন সমাজ—বাস্তবায়ন করতে পেরেছি?
আজও সমাজের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য, দুর্নীতি ও অন্যায়ের উপস্থিতি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। বিজয়ের প্রকৃত অর্থ তখনই পূর্ণতা পায়, যখন সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা কেবল অর্জনের বিষয় নয়; এটি প্রতিদিন রক্ষা করার দায়।
বিজয় দিবস নতুন প্রজন্মের কাছেও একটি বড় দায়িত্বের নাম। ইতিহাস জানা, মুক্তিযুদ্ধের সত্য তুলে ধরা এবং বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া তাদের কর্তব্য। লাল-সবুজের পতাকা শুধু আবেগের প্রতীক নয়; এটি ন্যায়, সাহস ও দায়িত্ববোধের চিহ্ন।
আজ ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয়ের এই দিনে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের নতুন করে শপথ নেওয়ার সময়। শপথ—এই দেশকে ভালোবাসব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াব, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কলম ধরব। তবেই লাল-সবুজের বিজয়গাথা শুধু ইতিহাসে নয়, বাস্তব জীবনেও প্রতিফলিত হবে।