
মৌলভীবাজারে সম্প্রতি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনাকে কেন্দ্র কওে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। লেখক, কবি, সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত সালেহ আহমদ (স’লিপক) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গাছের মোড়া দিয়ে চেয়ার তৈরির তিনটি ছবি পোস্ট করে লেখেন “চেয়ার তৈরিতে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছি”। এই পোস্টের পরপরই মৌলভীবাজারসহ সিলেট অঞ্চলে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে।
স্থানীয় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এর আগে কখনো তারা সালেহ আহমদকে কাঠের কাজ বা চেয়ার তৈরির সঙ্গে যুক্ত হতে দেখেননি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে— এটি কি নতুন কোনো পেশা, নাকি প্রতীকী কোনো বার্তা?
সমালোচনা ও ব্যক্তিগত মন্তব্য
কবি মিনারা আজমি এ বিষয়ে বলেন, “আমার জীবনে শুনিনি বা দেখিনি তিনি এমন কাজ করতে। এমনকি ঘরের ছোটখাটো কাজও করতেন না। হঠাৎ কেন তিনি নিজেকে কাটমিস্ত্রি হিসেবে উপস্থাপন করছেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়।”
মুক্তিবাণী নিউজের সম্পাদক ও প্রকাশক মো. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, “আমি সাধারণত মন্তব্য করতে চাই না। তবে একজন সাংবাদিক কতটা নাটকীয় হতে পারেন, তারই উদাহরণ সালেহ আহমদ। ছবিতে তাকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ কবি আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন,
“ মফস্বলের সাংবাদিকতার আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন হয়তো সালেহ ভাই। কিছুদিন পূর্বে তার কাছে কর অফিস থেকে নোটিশ আসে, সেটাও কারণ হতে পারে।”
সাংবাদিক ইউনিয়নের বক্তব্য
তবে এসব মন্তব্যের বাইরে গিয়ে বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন মৌলভীবাজার জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, “সাংবাদিকতার পাশাপাশি অন্য কাজ না করলে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা না খেয়ে মরবে। সংসার ভেঙে যাবে। বাস্তবতা এটাই।”
প্রবাসে পরিশ্রমের বাস্তব চিত্র
অনুসন্ধানে দেখা যায়, পেশার সম্মান নিয়ে এই বিতর্ক কেবল সালেহ আহমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রবাসে থাকা বহু খ্যাতিমান সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী জীবিকার তাগিদে ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন এটাই বাস্তবতা।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত dazzlingdawn.com-এর সম্পাদক ও প্রকাশক মুনজের আহমদ চৌধুরী নিজেই একাধিকবার বলেছেন, যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর তিনি চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদকের পাশাপাশি একটি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ভারতীয় রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। এমন কি এখনও কওে যাচ্ছেন।
আমেরিকায় বসবাসকারী কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও একুশে টেলিভিশনের সাবেক ক্রাইম রিপোর্টার মো. ইলিয়াছ হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ইউটিউব বা ফেসবুকই একমাত্র আয়ের উৎস নয়। আমি উবার চালিয়ে জীবন চালাচ্ছি।”
এমনকি ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন নিজে জুতা সেলাই করতেন। তাঁর বাবা ছিলেন পেশায় জুতা প্রস্তুুতকারক। এই শ্রমই তাঁকে আত্মমর্যাদা ও সংগ্রামের শিক্ষা দিয়েছিল।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রমের মর্যাদা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ইসলামে শ্রমের মর্যাদা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই বলেছেন, “আমি একসময় মেষ চরাতাম।” ইসলামের দৃষ্টিতে পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হালাল রিজিকই সর্বোত্তম।
বাংলাদেশের পেশাগত বৈষম্য
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বড় একটি সমস্যা হলো পেশাগত বৈষম্য। এখানে কলমের কাজকে সম্মান দেওয়া হলেও হাতের কাজকে ছোট করে দেখা হয়। অথচ কানাডা, আমেরিকা কিংবা যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি প্রবাসীরা রেস্টুরেন্টে বয়, মাংস কাটার কাজ, ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক কিংবা ক্লিনার হিসেবে কাজ করে সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করছেন। যেসব পেশাকে বাংলাদেশে তুচ্ছ করা হয়, সেগুলোই উন্নত বিশ্বে সম্মানজনক।
মফস্বল সাংবাদিকতার বাস্তবতা : অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, বাংলাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৯০ শতাংশ সাংবাদিক কোনো নিয়মিত বেতন পান না। সর্বোচ্চ বেতন ৮-১০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের উল্টো প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিতে হয় – এমন অভিযোগের প্রমাণও রয়েছে। ফলে বহু সাংবাদিক বাধ্য হয়ে বিকল্প পেশা বেছে নিচ্ছেন।
উপসংহার : এই বাস্তবতায় সালেহ আহমদ (স’লিপক) যদি সত্যিই চেয়ার তৈরির মতো শ্রমনির্ভর কাজে যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, তবে সেটি লজ্জার নয়, বরং সম্মানের। প্রশ্ন হওয়া উচিত, কেন একজন লেখক-সাংবাদিককে বাঁচতে গিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।