প্রথমেই সম্মান জানাই সকল প্রকৃত সংবাদকর্মীকে। সাংবাদিকতা শুধু একটি পেশা নয়—এটি সমাজের বিবেক, সত্য প্রকাশের পবিত্র দায়িত্ব। সৎ সাংবাদিকদের নিরলস পরিশ্রমেই সমাজ আলোকিত হয়, গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়, দুর্নীতি ও অন্যায় উন্মোচিত হয়। তাই প্রকৃত সাংবাদিকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই আজকের লেখাটি শুরু করছি।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, চট্টগ্রামে সাংবাদিকতার আড়ালে এক শ্রেণীর নামসর্বস্ব ব্যক্তি এখন ভিক্ষাভিত্তিক সংস্কৃতি চালু করেছে। সংবাদ সম্মেলনের নামে তারা অসহায় মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করছে, চাঁদা আদায় করছে, আর সংবাদকে ব্যবসার পণ্যে রূপান্তর করছে। এরা সাংবাদিক নয়, বরং সাংবাদিকতার নাম কলঙ্কিত করা একদল সুবিধাভোগী।
“ভিক্ষা নয়, সাংবাদিকতা” — প্রেস ক্লাবের ঘোষণা-সম্প্রতি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে দেওয়া নোটিশ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নোটিশে স্পষ্ট বলা হয়েছে—প্রেস ক্লাবে আসা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় কিংবা চাপ প্রয়োগের মতো কাজ আর সহ্য করা হবে না। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে এসব অনিয়ম প্রমাণিত হলে দায়ীদের প্রেস ক্লাব চত্বরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে। এটি শুধু একটি নোটিশ নয়—এটি সাংবাদিকতার সম্মান বাঁচানোর যুদ্ধ ঘোষণা। কেন এই পদক্ষেপ জরুরি?
চট্টগ্রামে বাস্তবতা হলো, একটি সংবাদ সম্মেলনে অনেক সময় প্রকৃত সিনিয়র সাংবাদিকরা অংশ নেন না। কারণ, তাদের জায়গা দখল করে বসে থাকেন তথাকথিত সাংবাদিকরা। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য—‘হাত খরচ’ বা আলাদা প্যাকেট নেওয়া।
একজন অসহায় গরিব মানুষ তার সমস্যার কথা জানাতে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। অথচ তিনি উল্টো পড়েন মিডিয়া চাঁদাবাজির শিকার। তার বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রচার হবে কি না, তা নির্ভর করছে তিনি কত টাকা দিতে পারছেন তার উপর! এটি সাংবাদিকতা নয়—এটি মানবিকতার সাথে নিষ্ঠুর প্রতারণা।
সত্যিকারের সাংবাদিক বনাম নামসর্বস্ব সাংবাদিক-যেখানে একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের কাজ হলো—সমাজের সমস্যাকে আলোকিত করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো,
প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠকে তুলে ধরা,
সেখানে নামসর্বস্ব সাংবাদিকদের কাজ পরিণত হয়েছে— আমন্ত্রণ না পেলেও প্রবেশ করা,
সংবাদ সম্মেলনে বসে থাকা শুধু হাত খরচের জন্য, নিউজ বিক্রি করা, আর আয়োজকের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা।
মালিকপক্ষের দায়ও আছে-এখানে একটি বড় প্রশ্ন—এরা সুযোগ পাচ্ছে কীভাবে?
কিছু পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল সাংবাদিক নিয়োগ দিলেও কোনো বেতন দেয় না। কেবল একটি কার্ড দিয়ে বলে—“নিজের ব্যবস্থা করে নাও।” তখন এরা কার্ডের প্রভাব খাটিয়ে মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায়কে নিত্যদিনের কাজে পরিণত করে। এর দায় তাই শুধু নামসর্বস্ব সাংবাদিকদের নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীন মালিকপক্ষকেও নিতে হবে। প্রেস ক্লাব কর্মচারীদের অনিয়ম-প্রেস ক্লাবের ভেতরেও কিছু অসঙ্গতি বহুদিন ধরেই চলছে। নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করেও আয়োজকদের কাছ থেকে কর্মচারীদের বকশিশ, নাস্তার খরচ, আলাদা প্যাকেট দাবি করা দুঃখজনক। এটি প্রেস ক্লাবের মর্যাদার সাথে যায় না। তাই প্রেস ক্লাবের নতুন নেতৃত্ব এই অনিয়মগুলোতেও কঠোর নজর দেবেন বলে আশাবাদী।
সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষার লড়াই-চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এই উদ্যোগ স্বাগত জানাই। সাংবাদিকতা কখনো ভিক্ষাভিত্তিক পেশা হতে পারে না। এটি পবিত্র দায়িত্ব, এটি কলমের যুদ্ধ, এটি সত্যের সাধনা। তাই আমাদের প্রত্যাশা—
নামসর্বস্ব সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্যের অবসান হোক,পত্রিকা ও টিভি মালিকরা ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করুক, প্রেস ক্লাব কর্মচারীদেরও নিয়মের মধ্যে রাখা হোক।
আমরা চাই সাংবাদিকতা আবার তার আসল মর্যাদায় ফিরুক। কারণ, সাংবাদিকতা হলো সমাজের আয়না—আর সেই আয়না যদি দাগযুক্ত হয়, তাহলে পুরো সমাজই অন্ধকারে ঢেকে যাবে।