বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে সাংবাদিকদের সুরক্ষার বদলে একের পর এক নিয়ন্ত্রণমূলক আইন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন আর তার উত্তরসূরি ২০২৩ সালের সাইবার সিকিউরিটি আইন সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে শিকলে বেঁধে রেখেছিল। অস্পষ্ট ও কঠোর ধারাগুলো ব্যবহার করে অসংখ্য সাংবাদিককে হয়রানি, গ্রেপ্তার ও মামলার মুখে পড়তে হয়েছে। স্বাধীনভাবে কলম ধরা ছিল যেন অপরাধ। আমি সেই সময় থেকে বারবার লিখেছি, বলেছি—সাংবাদিকদের জন্য একটি কার্যকর সুরক্ষা আইন প্রণয়ন না করলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেবল কাগজে-কলমেই থাকবে। অসংখ্য নিবন্ধ, বক্তব্য আর আহ্বান দিয়েছি, কিন্তু সরকারের কানে পৌঁছায়নি। কিন্তু গাজীপুরের সাহসী সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ড সেই নীরবতা ভেঙে দিয়েছে। চাঁদাবাজি ও অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে কলম ধরায় তাকে জীবন দিতে হয়েছে। তার নির্মম মৃত্যু যেন দেশের বিবেককে নাড়িয়ে দিল। আমি তুহিন হত্যার পর আরও জোরালো ভাষায় লিখেছি, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি—সাংবাদিকদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, এটিকে আর বিলম্ব করা চলবে না।
আজ, সেই দীর্ঘ সংগ্রাম ও চাপের বাস্তবতায়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ‘সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে। খসড়ায় স্পষ্ট বলা হয়েছে—সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধের মাত্রাভেদে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ন্যূনতম এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে।বল প্রয়োগ করে সাংবাদিকের বাসায় প্রবেশ, তল্লাশি বা সম্পদ জব্দ করা অবৈধ।কোনো সরকারি কর্মচারী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথ্যসূত্র প্রকাশে বাধ্য করতে পারবে না।পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিককে ভয়ভীতি বা শারীরিক-মানসিক চাপমুক্ত রাখার দায়িত্ব সরকার ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের।যৌন হয়রানি, মিথ্যা মামলা, বেআইনি আটক—সবকিছুর বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
খসড়ার ভাষায় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২, ৩৯ ও ৪০-এর অধিকারগুলো পুনঃনিশ্চিত করা হয়েছে—জীবন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও পেশাগত স্বাধীনতা। এটি কেবল একটি আইনি দলিল নয়—এটি সাংবাদিক সমাজের জন্য ন্যায় ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। বহু বছর ধরে আমরা যে সুরক্ষা চাইছিলাম, আজ তা বাস্তবতার পথে হাঁটছে। তবে এখানেই থেমে গেলে চলবে না। আইন হবে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হবে কি না, সেটিই আসল প্রশ্ন। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে—আইন কেবল বইয়ের পাতায় থাকলে তা কোনো জীবন বাঁচাতে পারে না। আজ তুহিন নেই, কিন্তু তার রক্তে লেখা বার্তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়া মানে গণতন্ত্রের প্রাণ বাঁচানো।