সময় এক অদ্ভুত স্রোত। কিছু মানুষ সেই স্রোতে হারিয়ে যায়, কেউবা সে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে হয়ে ওঠে সময়ের সাক্ষ্য, সত্যের পথিক। সাংবাদিক মহসিন কাজী এমন একজন মানুষ—যিনি সাংবাদিকতাকে পেশা নয়, এক প্রকার ব্রত ও বিবেকের অনুশীলন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আজকের লেখাটি কেবল স্মৃতিচারণ নয়; এটি এক যোদ্ধার প্রতি আমার সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার গাথা।
আমার সঙ্গে মহসিন কাজীর সম্পর্ক শুরু হয় নব্বই দশকের শুরুর দিকে। তখন আমরা দুজনই লেখালেখির দুনিয়ায় নিজেদের জায়গা করে নিতে ব্যস্ত। কিন্তু এই সম্পর্ক ছিল শুধু সহকর্মিতার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়—তা ছিল বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের এক গভীর মেলবন্ধন, হৃদ্যতার বন্ধন। তার আচরণে ছিল আন্তরিকতা, কথায় ছিল স্পষ্টতা, কাজে ছিল নির্ভীকতা।
মহসিন কাজী কখনো সাংবাদিকতা করেননি নিজের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে। তিনি সাংবাদিকতা করেছেন নিজের ভেতরের তাগিদে। তার কলম ছিল প্রতিবাদের প্রতীক। তিনি সেই মানুষ, যিনি কখনো সাদাকে কালো কিংবা কালোকে সাদা বলেননি। সাংবাদিকতা ছিল তার কাছে দায়িত্ব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আত্মিক যুদ্ধ। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি কাজ করেছেন দৈনিক “আজকের কাগজে”। তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনগুলো তখন পাঠকদের মুগ্ধ করত। তার লেখা ছিল তথ্যনির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ এবং সাহসিকতায় পরিপূর্ণ। অনেক সময় তার লেখায় এমন সব সত্য উঠে আসতো, যা অন্য কেউ বলার সাহস করতেন না। তাই হয়তো আজও আমরা বলি—মহসিন কাজীর মতো কলম সৈনিক আর কজন আছে? আমাদের সম্পর্ক কেবল পেশাগত নয়, ছিল পারিবারিক। আমি প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। সেই বিয়েতে আমন্ত্রণ না পেয়ে সে রাগ করে ছিল, কিন্তু প্রথম বইমেলায় তার হাতে ধরা খেয়েছিলাম—এই গল্প আমরা এখনও হেসে হেসে বলি। তার প্রিয় ছিল আমার স্ত্রীর বানানো শীতল পিঠা। বলত—”ভাবীর পিঠা তো ঠিক আমার মায়ের মতো!” এই এক বাক্যে তার হৃদয়ের গভীরতা বোঝা যায়। মানুষের প্রতি, বন্ধুর প্রতি তার আন্তরিকতা ছিল নিখাদ। ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রাম থেকে আমরা কয়েকজন মিলে শুরু করেছিলাম এক যুগান্তকারী প্রচেষ্টা—চার রঙের জাতীয় মানের ম্যাগাজিন “চট্রল চিত্র”। এর সম্পাদক ছিলেন গবেষক সাংবাদিক জামাল উদ্দিন, আমি ছিলাম নির্বাহী সম্পাদক। আর মহসিন কাজী ও রিয়াজ হায়দার চৌধুরী ছিলেন রাজনৈতিক প্রতিবেদক।এই ম্যাগাজিন ছিল শুধু একটি প্রকাশনা নয়, ছিল আমাদের স্বপ্ন, শ্রদ্ধা, শ্রম ও সাধনার সমবেত ফল। আমার নিজের লেখা ছিল চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা আন্দোলন নিয়ে। সেই আন্দোলনের বিবরণ আমি গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়ে লিখেছিলাম। প্রথম সংখ্যার প্রকাশ উপলক্ষে আমরা সকলে মিলে গিয়েছিলাম মোগল বিরানিতে। সকালে বিরিয়ানি খাওয়া সেই দিনটি আজো মহসিন ভুলে না। এতদিন পরও তার স্মৃতিতে সেই দিনের রঙ স্পষ্ট—এই তো সম্পর্কের সৌন্দর্য। পরবর্তীতে বাংলা টিভির “চট্টগ্রাম সংলাপ” অনুষ্ঠানে আমি উপস্থাপনায় ছিলাম, আর মহসিন কাজী ছিলেন নিয়মিত আলোচক। তার বিশ্লেষণ, যুক্তি, ভাষার সৌন্দর্য—সবকিছু মুগ্ধ করত দর্শক শ্রোতাকে। তিনি এমনভাবে কথা বলতেন, যেন লেখার কলমটা টেলিভিশনের মাইক্রোফোনে রূপ নিয়েছে। সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সমাজ—সব বিষয়ে তার গভীর পড়াশোনা ছিল। টকশোতে তিনি শুধু মতামত দিতেন না, তিনি তথ্যের খনি খুলে দিতেন। মানুষ তাকে বলতো—‘চট্টগ্রামের চলন্ত বিশ্লেষণ’!
একবার, চকবাজার এলাকার কিছু সন্ত্রাসী “খবর গ্রুপ”-এর অফিসে ঝামেলা করেছিল।মহসিন তখন দৈনিক খবরে কাজ করেন, সেই সময়ে মহসিন আমার সহযোগিতা চাইল। আমরা একসাথে মিলেই সমস্যার সমাধান করেছিলাম। তখনই ওবায়দুর রহমান ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়, যা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিল। এইসব সম্পর্ক, সহযোগিতা, ভালোবাসা—এসবই মহসিনের চরিত্রকে আরও উজ্জ্বল করে। তিনি ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক নন, বরং মানুষের জন্য নিবেদিত। গতরাতে হঠাৎ তার সঙ্গে ফোনে দীর্ঘ সময় কথা হলো। স্মৃতির পাতায় পাতায় আমরা হাঁটলাম—হাসলাম, কিছুটা নীরবও হলাম। কিন্তু সবচেয়ে স্পষ্ট ও বেদনাদায়ক ছিল তার একটি মন্তব্য—“এখন আর কেউ নিয়মিত লিখে না; শুধু নামসর্বস্ব সাংবাদিকতা বাড়ছে।”এই হতাশা শুধু তার একার নয়, আমাদের সবার। সাংবাদিকতা আজ অনেকটাই চাকরি হয়ে গেছে। সত্য আর অনুসন্ধান এখন বিজ্ঞাপন ও পেইড কনটেন্টে চাপা পড়ে যাচ্ছে। অথচ মহসিন কাজী ছিলেন অনুসন্ধানের, দায়িত্বের, এবং আত্মার সাংবাদিক। একজন মহসিন কাজীকে নিয়ে লেখা শেষ করা যায় না। তিনি শুধু সাংবাদিক নন, তিনি ছিলেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তার লেখনী যেমন সমাজের প্রতিচ্ছবি, তেমনি তার জীবন আমাদের জন্য এক পাঠশালা। আজকের এই লেখাটি আমার হৃদয়ের নিবেদন—একজন ভাই, বন্ধু, সহযোদ্ধা এবং সত্যের সৈনিকের উদ্দেশ্যে।মহসিন কাজী আজও আমাদের মাঝে আছেন, থাকবেন তার সাহসিকতা, সততা, স্বচ্ছতা আর গভীর মানবিকতায়। তার লেখা, তার কথা, তার হাসিমুখ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আসল সাংবাদিকতা কখনো হারিয়ে যায় না। সত্যের পথ যতই বন্ধুর হোক, মহসিন কাজীর মতো কিছু মানুষ সেই পথেই হাঁটে, দীপ্ত পায়ে।আমরা গর্ব করি, তার মতো একজনকে আমরা পেয়েছিলাম।