সুরের সমাধি, সাধনার দ্যুতি: মাইজভাণ্ডারী কণ্ঠসাধক দিল আফরোজ”
-একজন শিল্পীর অন্তরলোক, যার সুরে জেগে ওঠে বাংলার আধ্যাত্মিক চেতনা-
এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্মান একেবারেই ভিন্ন আলো নিয়ে। তারা প্রতিযোগিতা করে না, তারা নিজের ছায়া নিয়েই চলেন। তাদের কেউ তুলনা করতে গেলেই, উত্তর আসে একটাই—“তিনি নিজেই তাঁর তুলনা।”
দিল আফরোজ, তেমনই এক শিল্পী, যাঁর কণ্ঠের গভীরে বাজে বাংলার শতাব্দী পেরোনো আত্মার বীণা। তিনি কেবল একজন সঙ্গীতশিল্পী নন, তিনি একজন আধ্যাত্মিক অনুরাগিনী, একজন সুরের সাধক, যিনি তার কণ্ঠে বহন করেন চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের সুবাস, বাংলার আধ্যাত্মিক গানের ঐতিহ্য।
দিল আফরোজের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল বছর কয়েক আগে, একটি সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি ছিল নির্ভার, অথচ প্রভাবশালী। যখন তিনি গাইতে শুরু করলেন, পুরো পরিবেশ যেন অন্য এক মাত্রায় প্রবেশ করল। শ্রোতারা বুঝে উঠতে পারল না, গানটা শুনছে নাকি অনুভব করছে। সেই মুহূর্ত থেকেই আমি বুঝেছিলাম—এই মানুষটি শিল্পী নন, শিল্পেরই এক আরাধ্য প্রতিমা।
ছোটবেলা থেকেই সংগীতচর্চায় নিবিষ্ট এই কণ্ঠসাধিকা সংগীতকে কখনোই শুধুমাত্র বিনোদন হিসেবে দেখেননি। তাঁর কাছে সংগীত মানে সাধনা, আত্মশুদ্ধি, ঈশ্বরপ্রাপ্তির এক সরল পথ। আর সে কারণেই তিনি বেছে নিয়েছেন মাইজভাণ্ডারী সঙ্গীত—বাংলার হৃদয়স্পর্শী সুফি ধারার এক অলৌকিক সংগীতভুবন, যেখানে প্রেম আর পরিতাপ, জাগরণ আর দীক্ষা, মানবতা আর মরমি উপলব্ধি একত্রে মিশে যায়।
দিল আফরোজ একজন চলমান চেতনা।
তিনি মাইজভাণ্ডারী তরিকার একজন অনুসারী হিসেবে কেবল ধর্মীয় আবেগ নয়, আত্মার গভীরতা দিয়েই গানকে হৃদয়স্থ করেন। তাঁর প্রতিটি গানে ভেসে আসে সেই মাইজভাণ্ডারী ভাবধারার অনুরণন—“ভালোবাসা মানেই ত্যাগ, ভক্তি মানেই আত্মসমর্পণ।”
তাঁর কণ্ঠস্বর শুধু সঙ্গীত পরিবেশন করে না, এটা একেকটি আত্মার উচ্চারণ, দেহাতীত অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি। শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ, সূক্ষ্ম রাগজ্ঞান, তালরক্ষার অভূতপূর্ব ক্ষমতা আর সবচেয়ে বড় কথা—সততা—তাঁকে করে তুলেছে একজন ‘জীবন্ত সংরক্ষক’ মাইজভাণ্ডারী গানের।
তিনি শুধু গায়কী দিয়েই শ্রোতাকে মুগ্ধ করেন না, তাঁর সৌন্দর্য, সৌজন্য এবং আত্মবিশ্বাসও তাঁকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। বয়স যেন তাঁর মুখচোখ ছুঁয়ে দেখেও ফিরে গেছে—তাঁর সৌন্দর্য এখনো অপার, সতেজ, আভিজাত্যে পূর্ণ।
দিল আফরোজ একাধারে একজন সমাজ সচেতন নারী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, ও একজন পথপ্রদর্শক। চট্টগ্রামের সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম সংগঠন “চাটগাঁইয়া নওজোয়ান”-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তরুণ শিল্পীদের পথপ্রদর্শক হয়ে তিনি যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি নিজে থেকেও শেখার চেষ্টা করেছেন সর্বক্ষণ।
দিল আফরোজের গানের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর শ্রোতাকে চেনার ক্ষমতা। তিনি বুঝতে পারেন, কে কোন গান শুনলে হাসবে, কে কোন সুরে কাঁদবে। এ এক বিশাল মননশীলতা, যা প্রতিটি মহান শিল্পীর মধ্যে জন্মায় বছরের সাধনায়।
তিনি একজন ‘গানবিলাসী নয়, গানের উপাসক।’
এই উপাসনার মধ্য দিয়েই দিল আফরোজ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন এক নতুন চট্টগ্রাম—যেখানে আধুনিকতা আর আধ্যাত্মিকতা পাশাপাশি হাঁটে, যেখানে নারী কণ্ঠ শুধু নয়, নারী চেতনাও শক্তিশালী হয়ে ওঠে শিল্পে, সাধনায় ও সমাজে। দিল আফরোজ নামটি এখন আর শুধুমাত্র একজন শিল্পীর নাম নয়—এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক, একটি মাইজভাণ্ডারী ভাবনার জ্যোতির্ময় মুখ, একটি স্মরণীয় কণ্ঠযাত্রার দৃষ্টান্ত।
এই বাংলায় যতদিন মরমি গান বাজবে, যতদিন সুফি চেতনার বাতাস বইবে, ততদিন দিল আফরোজ নামটি উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।