গল্পে গল্পে জীবন কথা–
নলকূপের ঘর”
কাঁদা-মাটিতে ভেজা এক বিকেল। শহরের শেষ প্রান্তে, যেখানে রাস্তার আলো পৌঁছায় না, সেখানে পড়ে আছে একটি পরিত্যক্ত সিমেন্টের নলকূপ। তার গায়ে ছেঁড়া বস্তা, চারপাশে আগাছা। এই নলকূপটাই এখন একটা পরিবারের ঘর।
ঘরের মাথায় বসে আছে এক পুরুষ—শরীরে বারো মাসের ধুলোময় ক্লান্তি। ভেতরে বসে আছে তার স্ত্রী আর তিনটি শিশু। কোনো কিছু নেই তাদের কাছে, শুধু কয়েকটা পুরনো হাঁড়ি আর ক্ষুধারত চোখ। আর সেই চোখে এক ধরনের অদ্ভুত অনড়তা—যা ভয় নয়, অভ্যস্ততা।
পুরুষটির নাম মনির। একসময় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে কাজ করত। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায়। কাজ হারায়, বাসা হারায়, হারায় পরিচয়। তার স্ত্রী রাশিদা, একসময় পরিচারিকার কাজ করত। কিন্তু সন্তানদের নিয়ে কোথাও ঠাঁই পায়নি। শেষে এই নলকূপে এসে আশ্রয় নেয়।
এই নলকূপটাই এখন তাদের ঠিকানা।
এই পরিবারটা একক নয়। এমন আরও অসংখ্য পরিবার আছে শহরের প্রান্তে। তারা বাস করে রেললাইন ঘেঁষে, ড্রেনের ধারে, নির্মাণাধীন ভবনের নিচে। শহরের ভেতর এক দেশ আছে—আরেকটা শহর, যেখানে আলো নেই, অধিকার নেই, মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ নেই।
এই শহরে প্রতিদিন কোটিপতি বাড়ে, ফ্লাইওভার উঠে, আলো ঝলমলে বিলবোর্ডে হাসে কিছু মুখ, কিন্তু মনিরদের ছবি কোথাও থাকে না। তাদের জীবনের খবর কেউ রাখে না। তারা থাকে পেছনের গলিতে, বাতাসের নিচে, রাষ্ট্রের চোখের আড়ালে।
রাশিদা একদিন একটি চিঠি লেখে—কিন্তু সেটা ডাকঘরে যায় না। সেটা সে পড়ে শোনায় তার তিন সন্তানকে।
“রাষ্ট্র,
তোমাকে আমরা চিনি না। তুমি কোথায় থাকো, আমাদের জানা নেই। কিন্তু তুমি বলো, তুমি সকলের মা-বাবা। তাহলে তুমি কেন আমাদের দিকে ফিরে তাকাও না?
আমার সন্তানগুলো মানুষ হয়ে বড় হতে চায়। কিন্তু স্কুলে যেতে পারে না, কেননা স্কুলের কাছে আমাদের কোনো ঠিকানা নেই।
তুমি কি পারো না, আমাদের মতো পরিবারকে একটু মাটি, একটু আলো, একটু মানবতা দিতে?”
চিঠিটা শেষ হয় চোখের জলে, আর তিনটি শিশুর নিঃশব্দ চাহনিতে।
একদিন শহরের এক তরুণ সাংবাদিক ছবি তোলে এই নলকূপঘরের। ছবিটা ভাইরাল হয়, আলোচনা শুরু হয়। কেউ সমবেদনা জানায়, কেউ সমালোচনা করে, কেউ চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু একটা কিছু বদলায়।
কয়েকজন তরুণ এগিয়ে আসে। তারা খাবার দেয়, কাপড় দেয়, একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। এই ছোট পদক্ষেপ একটা আন্দোলনের সূচনা করে—”প্রতিটি পরিবারের একটি ঠিকানা চাই।”
এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে আরও অনেক মনির, রাশিদা আর তাদের মতো মানুষ।
বছরখানেক পর, সেই নলকূপ আজও পড়ে আছে—তবে এখন সেটার উপর একটি ফলক বসানো:
“এখানেই শুরু হয়েছিল ‘নলকূপের ঘর’ আন্দোলন, যেখানে একটা পরিবার ঘরের স্বপ্ন দেখেছিল।”
মনির আজ একটু বয়স্ক, রাশিদা এখন আশ্রয় কেন্দ্রে রান্না শেখায়, তাদের বড় সন্তান স্কুলে যায়।
এখনও জীবন কঠিন, কিন্তু তারা আর আশ্রয়হীন নয়।
তাদের মাথার ওপর একটা ছোট্ট ছাদের মতোই—আছে মানুষের বিবেক, ভালোবাসা, প্রতিবাদ আর আশা।
চলবে—