রাজধানীজুড়ে সম্প্রতি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এক বিস্ময়কর ব্ল্যাকমেইল কাহিনি। মডেল, উদ্যোক্তা ও সাবেক ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ বিজয়ী মেঘনা আলমকে ঘিরে নির্মিত এক চক্রের ফাঁদে আটকা পড়েছিলেন একাধিক বিদেশি কূটনীতিক ও দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনায় টার্গেট করা হয়েছিল সৌদি আরবের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ বিন ঈসা আল দুহাইলানকে।
ডিবি পুলিশ ও তদন্ত সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন মেঘনা। পরবর্তীতে তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও ধারণ করে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলের খেলা। দাবি করা হয় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৫০ কোটি টাকা)। কৌশলী প্রণয়ের ফাঁদ-
সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পরিচয় হয় আট মাস আগে। পরবর্তীতে কৌশলে বন্ধুত্ব, তারপর ঘনিষ্ঠতা—সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। জানা যায়, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর তাদের মধ্যে বাগদান হয়েছে বলে দাবি করেছে মেঘনার পরিবার, যদিও কোনো প্রমাণ মেলেনি। এই ব্ল্যাকমেইলের নেপথ্যে ছিলেন একজন শক্তিশালী চক্রনেতা—মানব পাচারকারী মো. দেওয়ান সমীর। যিনি দীর্ঘদিন ধরে সৌন্দর্য, প্রলোভন ও প্রেমের অভিনয়ে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করে আসছেন। তিনি ছিলেন কাওয়ালী নামক প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং সানজানা নামক ম্যানপাওয়ার কোম্পানির মালিক। মূলত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আড়ালে চলে প্রতারণা ও পাচারের চক্র।
গ্রেফতার, রিমান্ড ও তদন্তের বিস্ময়- ৯ এপ্রিল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে মেঘনাকে আটক করে ডিবি। আটকের সময় ফেসবুক লাইভে এসে তিনি অভিযোগ করেন, ‘পুলিশ পরিচয়ে কিছু লোক তার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।’ পরদিনই তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেওয়া হয় এবং পাঠানো হয় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।
মেঘনার সহযোগী দেওয়ান সমীরকেও গ্রেফতার করা হয় এবং ভাটারা থানায় দায়ের হওয়া মামলায় তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য ফাঁস করেছেন সমীর। তিনি জানিয়েছেন, এ চক্রের মাধ্যমে একাধিক হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি ফাঁদে পড়েছেন এবং অর্থ দিয়েছেন লোকলজ্জা ও সম্মান রক্ষার ভয়ে। ডিবি প্রধানের প্রত্যাহার ও প্রশাসনের অস্বস্তি–এই ঘটনার জেরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান রেজাউল করিম মল্লিককে হঠাৎ করেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, মেঘনা আলম সংক্রান্ত বিতর্ক ও মামলার জেরেই এই প্রত্যাহার। এদিকে হাইকোর্ট মেঘনার গ্রেফতার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিচারপতি রাজিক আল জলিল ও বিচারপতি তামান্না রহমান খালিদের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করে জানতে চেয়েছেন, ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার, কারণ না জানিয়ে আটক, ২৪ ঘণ্টার বেশি ডিবি হেফাজতে রাখা, আইনজীবীর সহায়তা না দেওয়া এবং ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়া আটকাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না। একজন মডেলের দ্বৈত জীবন-
মেঘনার ব্যক্তিগত জীবনও এখন আলোচনায়। বরিশাল থেকে আসা এই তরুণী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ করেন। ২০২০ সালে ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি, পরিচিত ছিলেন উদ্যোক্তা হিসেবেও। কিন্তু তার নামে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা শুধু আর্থিক প্রতারণা নয়—এতে জড়িত দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনানুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়েছে, একজন নারী রাষ্ট্রদূতকে আর্থিক সুবিধা আদায়ে হুমকি দিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্তের নির্দেশ দেয়, যার ফলেই মেঘনার গ্রেফতার। সমাজ, রাজনীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন–এ ঘটনাটি শুধু একটি প্রতারণা নয়, বরং আমাদের সমাজের এক গভীরতর অসুখের প্রতিচ্ছবি। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে এমন ঘটনা দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আবার অপরাধ দমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা ও পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে—ওয়ারেন্টবিহীন গ্রেফতার, ফেসবুক লাইভে আসা এক নারী, এবং পুলিশের অসঙ্গত আচরণের অভিযোগ। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: কে বা কারা এই চক্রের পেছনে রয়েছে? কেবল মেঘনা ও সমীর নন, আরও কোনো শক্তিশালী গোষ্ঠী কি এসব ঘটনার পেছনে থেকে যাচ্ছে? দেখতে তিনি যেন এক স্বপ্নলোকের নারী। সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ আর ‘লাভ’ তাকে পূর্ণিমার মতো ঝলমল করে তুলেছে। ক্যামেরার সামনে হাসি, পেছনে ফাঁদ; এক হাতে সেলফি, অন্য হাতে ব্ল্যাকমেইলের স্ক্রিপ্ট। তিনি মডেল, উদ্যোক্তা, পুরস্কারজয়ী, আবার জেল-প্রাপ্ত—সবই একসঙ্গে। তিনি আমাদের সমাজের নতুন প্রজাতির প্রতিনিধি: রূপকজীবী।
এরা রূপে বাঁচে, রূপে চলে, রূপে শিকার করে। এদের কাছে সৌন্দর্য শুধু আয়না ভাঙার নয়, তা দিয়ে ভাঙা যায় রাষ্ট্রদূতের বিবেক, ব্যবসায়ীর মান-ইজ্জত, এমনকি কূটনীতির শৃঙ্খলাও। এরা যখন ফেসবুকে হাসে, তখন কোনো না কোনো হাইপ্রোফাইল পুরুষের রাত ঘুম উধাও হয়। “Hi dear!” দিয়ে শুরু, “I have your video” দিয়ে শেষ। মেঘনা আলম সেই রূপকজীবী নারীদের মুখপাত্র, যারা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘উদ্যোক্তা’ বলে, কিন্তু আসলে তারা একেকজন হাইটেক ঠকবাজ। চোখের পলকে তারা ‘বাগদান’ করে, আবার ইচ্ছা করলেই ‘ধর্ষণের মামলা’ দিয়ে দেয়। তাদের প্রেমে পড়া মানে গোলকধাঁধায় পা রাখা, যেখানে প্রবেশ আছে, প্রস্থান নেই—শুধু বিকাশ নম্বর আর এনওসি চাওয়া হয়। এই নারীরা গুলশান-বসুন্ধরার মিঠে আলোয় বাস করে, কিন্তু তাদের মগজ চলে পুরান ঢাকার ছলচাতুরীতে। একেকটা লাইভ ভিডিও যেন মেগা সিরিয়াল—নাটক, কান্না, সাসপেন্স, আর শেষে স্লোগান: “আমি নারী, আমাকে বাঁচান”। অথচ কয়েকদিন আগেই সেই নারীর টেবিলে বসেছিল পাঁচ কোটি টাকার ব্ল্যাকমেইল চুক্তি!
এরা পুরুষ শিকার করে না, পুরুষকে ‘ব্র্যান্ড’ করে। যাকে ধরেছে, সেই রাষ্ট্রদূত, সেই মন্ত্রী, সেই ব্যবসায়ী একরকম মূর্ছা যান—মনে করেন প্রেমে পড়েছেন, আসলে পড়েছেন ফাঁদে। এ এক বিষম ভালোবাসা, যেখানে ভালোবাসার মূল্য তালিকাভুক্ত ডলার, আর উপহার হিসেবে থাকে গোয়েন্দা সংস্থার জেরা! রূপকজীবীরা ‘পজিটিভ নারীবাদ’ শব্দটির অপব্যবহার করে। যখন ধরা পড়ে, তখন নারীবাদী তাস খেলে। “পুরুষরা শিকারী”—এই পুরনো বুলি তুলে ধরে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে চায়। অথচ তারা নিজেরাই হাইপ্রোফাইল পুরুষদের শিকারে পরিণত করেছে, শুধু ‘ভিকটিম’ সাজার জন্য।
এরা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম ঘেরা জীবন নিয়ে এমন এক আভিজাত্য তৈরি করে, যেন দেশের অর্থনীতি তাদের ‘রিলস’ আর ‘রোমান্সে’ টিকে আছে। চাকরি নেই, কর দেয় না, কিন্তু গাড়ি আছে, গয়না আছে, বিদেশ ভ্রমণ আছে—এসব আসে কোথা থেকে? মেঘনাদের বায়োডাটা পড়লে মনে হয়, এরা পদ্মা সেতুও প্রেম করে বানাতে পারত! মেঘনা ও তার মতো রূপকজীবীদের সমাজের চোখে ফাঁকির নায়িকা বলা যায়। তারা একেকজন হুবহু শকুনের মতো—মরা নয়, বেঁচে থাকা সত্ত্বেও মানুষের সম্মান খায়। এদের প্রেমে যারা পড়ে, তাদের প্রয়োজন দ্রুত প্যারাসিটামল নয়, বরং আইন ও আত্মসচেতনতার ট্রিটমেন্ট। অতএব, রূপ নয়—গুণ দেখুন। লাইভ নয়—লাইফ দেখুন। মডেল নয়—মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করুন। কারণ মেঘনাদের হাসি হাজার ভোল্টের—যা দেখলে আপনি পুড়ে যাবেন, আর তারা? তারা তখন ফাঁদ পাতছে পরবর্তী শিকারের জন্য।