বসন্তের শেষ ধুলোমাখা হাওয়ায় যখন প্রকৃতি আপন অঙ্গার ঝেড়ে নতুন করে সেজে ওঠে, ঠিক তখনই বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ ধরা দেয়—একটি নব সূর্যোদয়ের মতো, একটি আশাবাদের গান হয়ে। কবি বলেছিলেন, “পহেলা বৈশাখ দিল ডাক নবীনের।” তবে আজ এই ডাক শুধু নবীন নয়, পহেলা বৈশাখ এখন পুরাতন-নবীন, গ্রাম-শহর, গৃহ-পরিবার, সব বাঙালির এক প্রাণের আর্তনাদ।
এই দিনটি শুধু একটি ক্যালেন্ডার পাল্টে ফেলার নাম নয়, এটি একটি অনুভব, একটি জাতিসত্তার উত্থান, ইতিহাসের গভীরতা থেকে উঠে আসা আত্মপরিচয়ের চাবিকাঠি। এককালে মোগল সম্রাট আকবর যখন এই বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল করতে বাংলা সনের সূচনা করেছিলেন, তখনই পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠেছিল জনজীবনের অংশ। সেসময় রাজদরবার থেকে শুরু করে প্রজাদের ঘরে ঘরে ‘নওরোজ’ উৎসবের ধ্বনি পৌঁছে যেত, আর তারই ধারাবাহিকতায় বাংলার বৈশাখ হয়ে ওঠে আশীর্বাদের মাস।
কিন্তু ইতিহাসের এক ঘোর অন্ধকার সময়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিষিদ্ধ করেছিল এই প্রাণের উৎসব। বাংলার গন্ধমাখা মাটিকে তারা ভুলে যেতে চেয়েছিল। অথচ সেই বৈশাখের রোদ, সেই কাঁচা আমের ঘ্রাণ, সেই ঢাক-ঢোল আর হালখাতার লাল পাড়ের নিমন্ত্রণপত্র—সবই ফিরে এসেছিল আবার, স্বাধীনতার ভোরে।
আজ, পহেলা বৈশাখ আমাদের কাছে শুধুই উৎসব নয়—এটি এক আত্মপ্রকাশ, এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, যেখানে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, এবং বাংলার মানুষ মিলেমিশে এক অপরূপ দৃশ্যপটে ধরা পড়ে। কবিগুরু যেমন বলেছিলেন, “উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ হয়,” ঠিক তেমনই, এই দিনে বাঙালি তার অন্তরের সব ছোটতা, সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে এক মহিমান্বিত সত্তায় পরিণত হয়।
পহেলা বৈশাখের দিনে চিরচেনা বাংলার চিত্র যেন হয়ে ওঠে এক জীবন্ত ক্যানভাস। গ্রামীণ মেলার ছায়ায় বসে থাকা সেই চটের ছাউনি ঘেরা দোকান, যেখানে বিক্রি হচ্ছে বাঁশি, বেলুন, রঙিন চুড়ি, আর পোড়ামাটির পুতুল—তার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা কিশোরীরা, যাদের চোখে স্বপ্নের মেলবন্ধন। ঐতিহ্য আর আধুনিকতা যেন হাত ধরাধরি করে চলে মুরির হাঁড়ি আর নববর্ষের কেকের পাশ দিয়ে।
পহেলা বৈশাখ কেবল শহরের রমনার বটমূলের মঙ্গল শোভাযাত্রা নয়, এটি গ্রামের মাটিতে শিশুর হাতে ধরা নতুন খেলনা, তরুণীর চুলে গাঁদা ফুল, হালখাতার লাল মোড়কের সৌরভে ভেসে থাকা একটি দোকানের প্রথম হাসি। এটি এমন এক দিন, যা গানে, কবিতায়, হেঁয়ালিতে, চিত্রকর্মে, আর গল্পে আবর্তিত হয় যুগে যুগে।
বৈশাখের আগমনে প্রকৃতি যেমন নতুন আঙ্গিকে ধরা দেয়, তেমনি মানুষের হৃদয়ও জেগে ওঠে। শিশুরা নতুন জামা পরে বেরিয়ে পড়ে মেলায়, বৃদ্ধেরা গুণগুণ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, আর নারীরা সেজে ওঠে লাল-সাদা শাড়ির ঐশ্বর্যে। এই দিনটিতে গ্রামীণ বাংলাদেশে যেন নিজেকে ফিরে পায়, আর নাগরিক বাংলা শহরের কংক্রিটের ভিড়েও খুঁজে নেয় এক টুকরো শেকড়ের গন্ধ।
এমন দিনে স্মৃতির পথ ধরে ফিরে আসে শৈশব—যখন সারা বছর টুকটাক জমিয়ে রাখা কয়েনের ঝুনঝুন শব্দে মেলা থেকে কেনা হতো কাঠের ঘোড়া, কিংবা রঙিন বাঁশি। তখন বৈশাখ ছিল এক রাজপুত্র, যার আগমনের জন্য ছিল চাতক পাখির মতো প্রতীক্ষা।
আজ, বাংলা নববর্ষ শুধু একটি দিন নয়—এটি বাঙালির আত্মার উৎসব, হৃদয়ের ভাষা, সংস্কৃতির অমর অভিষেক। সময় যতই যাক, বৈশাখ তার আদি রূপ হারায় না; বরং নতুন আঙ্গিকে, নতুন চেতনায়, প্রতিবার ফিরে আসে বলে, আমরা বারবার বলি—
“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো!”