বিশ্ববরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা ও কিংবদন্তি সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আমাদের ছেড়ে গেছেন। গতরাতে এই আলোকিত মানুষটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেশের সাংবাদিকতার অগ্রগামী এক পুরোধা, স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গর্বিত সৈনিক এবং চট্টগ্রামের মাটি থেকে উত্থিত এক মহান কৃতীসন্তান আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার প্রতি শেষ বিদায়ে যে আচরণ করা হয়েছে, তা শুধুমাত্র হৃদয়বিদারক নয়, বরং চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজের জন্য চরম লজ্জাজনক। নিজাম উদ্দিন ছিলেন চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার ভিত্তি নির্মাণে এক অগ্রদূত। তিনি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এবং সাংবাদিক ইউনিয়নের ইতিহাসের অংশ। তার পেশাগত সততা, আদর্শ এবং সাংবাদিকতার প্রতি নিষ্ঠা তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন সম্মানিত সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু আজ তার শেষ বিদায়ে চট্টগ্রামের সাংবাদিক সংগঠনগুলো এমন আচরণ দেখিয়েছে, যা ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে।
নিজাম উদ্দিনের জীবন ছিল সংগ্রাম, সাহস, এবং দেশপ্রেমের এক অনন্য উদাহরণ। তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের জন্য জীবন বাজি রাখা এই মানুষটি স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে ধারণ করে সাংবাদিকতা পেশায় অগ্রগতি এনেছিলেন। তার কলম সবসময় সত্যের পক্ষে ছিল। তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি, কখনো সাংবাদিকতার পবিত্রতাকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে কলঙ্কিত করেননি। কিন্তু আজ এই মহান ব্যক্তিত্বের দাফন সম্পন্ন হলো লোহাগড়ার নিজ বাড়িতে, অথচ চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজ থেকে তাকে সম্মান জানানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব বা সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কেউ এগিয়ে আসেনি। এই উপেক্ষা কেবল দুঃখজনক নয়, এটি আমাদের সমাজের নৈতিক দীনতার পরিচয় বহন করে। নিজাম উদ্দিন শুধু চট্টগ্রামের গর্ব ছিলেন না; তিনি ছিলেন পুরো দেশের সাংবাদিকতার একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যুর পর সারাদেশের মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জন্য শোক প্রকাশ করেছে। অথচ তার নিজের শহর চট্টগ্রামে সাংবাদিক সমাজের নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ। আজ আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি? এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখবো?
একজন কিংবদন্তি সাংবাদিক, একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন মানবতাবাদী মানুষকে আমরা শেষ বিদায়েও যথাযথ সম্মান জানাতে পারিনি। চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজের এ ঋণ শোধ করার কোনো পথ নেই। এই লজ্জা চিরকাল আমাদের বিবেককে কুরে কুরে খাবে। আজ আমরা হারালাম এক নক্ষত্র, কিন্তু তার প্রতি আমাদের আচরণ আমাদের মানসিক দৈন্যকেই তুলে ধরেছে। সময় এসেছে নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার। নিজাম উদ্দিনের মতো একজন গুণী মানুষের প্রতি সম্মান জানানো না শুধু তার প্রতি অবমাননা, বরং সাংবাদিকতার পেশার প্রতি অবমাননা।
ডেইলি অবজারভারের বিজনেস এডিটর ও জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন আহমদ আজ ২৯ শে জানুয়ারি ভোরে ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। নিজাম উদ্দিন আহমদ সাংবাদিকতা জগতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে ১৯৮০-এর দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং নিউ নেশন-এর ব্যুরো প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও, তিনি রয়টার্সের ঢাকা ব্যুরোতে দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নিজাম উদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত জীবনে অসংখ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের এক সাহসী সৈনিক, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য কাজ করেছেন। সাংবাদিকতার পেশায় তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও নেতৃত্ব অগ্রজ ও অনুজদের জন্য ছিল অনুপ্রেরণার উৎস।
নিজাম উদ্দিন আহমদের স্ত্রী জানিয়েছেন, আজ বাদ আসর চট্টগ্রামের লোহাগড়া উপজেলার আধুনগর গ্রামে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ, সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভুঁইয়া, এবং চিটাগং জার্নালিস্ট ফোরাম ঢাকা (সিজেএফডি)-এর সভাপতি মুজিব মাসুদ, সহ-সভাপতি কাশেম মাহমুদ এবং সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন রোকন। তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন এবং এই কিংবদন্তি সাংবাদিকের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন।
নিজাম উদ্দিন আহমদের মতো একজন গুণী মানুষ এবং দেশপ্রেমিক সাংবাদিকের মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর কর্ম ও আদর্শ চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
নিজাম উদ্দিন, আপনার জন্য আমাদের সমাজের এই আচরণ ক্ষমার অযোগ্য। আপনার অবদান চিরকাল স্মরণীয় থাকবে। আর আমরা চিরকাল প্রশ্ন করব নিজেদের—”এই লজ্জা কোথায় রাখি?”