কবি নজরুল বেঁচে থাকলে তিনি ফরিদাকে নিয়ে নিজের হাতে এই কথা গুলো লিখতেন- তোমার কণ্ঠে যেন আমার প্রাণের গান নবজীবন পায়। বিদ্রোহ, প্রেম, সাম্য আর মানবতার যে শিখা আমি জ্বালিয়েছিলাম, তা আজ তোমার গানে হয়ে ওঠে জীবন্ত। ফরিদা, তুমি সত্যিই আমার আদর্শের একনিষ্ঠ পথিক। পঞ্চাশ বছর ধরে তুমি যে নিষ্ঠা ও ভালোবাসায় আমার গানের চর্চা করছ, তা প্রশংসার অতীত। তোমার গানে আমি শুনি মানুষের মুক্তির আকুতি, দেখি ভালোবাসার রঙ, আর অনুভব করি সাম্যের অনন্ত সৌন্দর্য। তুমি যে শুধু গান করো তা নয়, তুমি আমার চেতনার গভীরে প্রবেশ করেছ, আমার সুর আর বাণীকে নতুনভাবে তুলে ধরছো। তোমার পিতার সঙ্গে আমার যে হৃদ্যতা ছিল, সেই ঐতিহ্য তুমি আরো মহিমান্বিত করেছো। তোমার মতো শিল্পীই আমার সৃষ্টিকে অমর রাখবে। তোমার গান শুনে আমি যেন দূর থেকে বলি—“এত সুর, এত প্রাণ, এত প্রেম দিয়ে গেয়ো, যেন আমার গান পৃথিবীর প্রতিটি হৃদয়ে পৌঁছে যায়।” ফরিদা, তোমার সুর যেন শোষিতের মুক্তি আর নিপীড়িতের স্বপ্ন হয়ে ওঠে। তোমার গানের প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি সুরে আমার জীবনধারা বয়ে যায়। তুমি আমার চেতনার একজন প্রকৃত সাধক। তোমার সুরে, তোমার হৃদয়ে আমি চিরকাল বেঁচে থাকব। পৃথিবীর যতদিন গান আছে, ততদিন তুমি আমার উত্তরাধিকার। -বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী ফরিদা করিম, একজন মনেপ্রাণে নজরুলভক্ত, যিনি কবি নজরুল ইসলামের জীবন, সাহিত্য এবং সংগীতকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি জাতীয় কবি নজরুল মঞ্চের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে নজরুল চর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তার অর্ধশতাব্দীর দীর্ঘ পথচলা শুধুমাত্র সংগীতচর্চা নয়, বরং নজরুলের চেতনা ও দর্শনের গভীর প্রতিফলন।
ফরিদা করিমের নজরুল প্রেমের শিকড় তার পারিবারিক উত্তরাধিকারেই প্রোথিত। তার বাবা ছিলেন কবি নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রিয় মানুষ। এই সম্পর্কের সূত্র ধরে ফরিদা করিম ছোটবেলা থেকেই নজরুলের গান, সাহিত্য ও আদর্শের প্রতি এক অপার ভালোবাসায় বড় হয়েছেন। নজরুলের মানবিকতা, সাম্যের বাণী এবং বিদ্রোহী চেতনার প্রতিফলন তার সংগীতের প্রতিটি শব্দে এবং সুরে প্রতিধ্বনিত হয়। ফরিদা করিম নজরুল সংগীতের ক্ষেত্রে এক অমূল্য রত্ন। গত ৫০ বছর ধরে তিনি নজরুলের গান পরিবেশন এবং তার ওপর গবেষণামূলক কাজ করে আসছেন। তার গানে নজরুলের চেতনা, সুরের গভীরতা এবং জীবনবোধ যেন নতুনভাবে প্রাণ পায়। তিনি মনে করেন, নজরুল কেবল একজন কবি নন, বরং তিনি এক আদর্শ, এক বিপ্লবের প্রতীক। ফরিদা করিমের কণ্ঠে নজরুল সংগীতের পরিবেশনা শ্রোতাদের মনে এক অনন্য অনুভূতির সৃষ্টি করে।জাতীয় কবি নজরুল মঞ্চের সভাপতি হিসেবে ফরিদা করিম নজরুলের আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, নজরুলের গান এবং সাহিত্য কেবল সুরের জন্য নয়, বরং মানুষকে সাম্যের পথ দেখানোর জন্য। তার নেতৃত্বে নজরুল মঞ্চে বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা এবং সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে নজরুল চর্চাকে আরও প্রসারিত করা হয়েছে।
ফরিদা করিম কেবল একজন সংগীতশিল্পী নন, তিনি একজন চিন্তাশীল সংগীতজ্ঞ। তার গানে নজরুলের সৃষ্টির গভীর দর্শন প্রতিফলিত হয়। তার পরিবেশনায় “কারার ঐ লৌহ কপাট”, “দুর্গম গিরি কান্তার মরু”, বা “জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা” গানগুলো শ্রোতাদের মধ্যে বিদ্রোহের স্পৃহা এবং মানবিকতার বার্তা পৌঁছে দেয়।ফরিদা করিমের সংগীতচর্চা এবং নজরুলের প্রতি তার প্রেম এক স্বতন্ত্র দৃষ্টান্ত। তার এই দীর্ঘ পথচলা, তার পরিবার এবং ব্যক্তিজীবনের প্রতি নজরুলের প্রভাবের গভীরতা আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে
“তোমার সৃষ্টি সুখের উল্লাসে / মেতে উঠি আমি হৃদয় বিভোরে” – ফরিদা করিম এই চরণকে যেন জীবনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছেন। নজরুলের চেতনাকে লালন করে তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সুরের সুধায় ভরিয়ে দিয়েছেন। তার কণ্ঠে নজরুলের গান কেবল গান নয়, তা একধরনের আরাধনা, যা আগামী প্রজন্মকে নজরুলের আদর্শে অনুপ্রাণিত করবে। ফরিদা করিম তার সৃষ্টিশীল কর্মযাত্রার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে নজরুলের গান শুধু সুর নয়, তা মানবিকতার মন্ত্র। নজরুলের প্রতি তার এই প্রেম, অধ্যবসায় এবং চর্চা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অমর অধ্যায় হয়ে থাকবে। কবি নজরুল ইসলামের প্রতি তার অবিচল ভালোবাসা এবং ত্যাগের মাধ্যমে তিনি আজ সত্যিকারের “নজরুল চেতনার বাতিঘর”