চট্টগ্রামের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে জসিমউদদীন চৌধুরীর নেতৃত্ব এক অনন্য অধ্যায়। তাঁর অসাধারণ মানবিকতা, ত্যাগ, আর কর্মদক্ষতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া এক অভিজ্ঞতা, যা হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। বহদ্দারহাট বান্দরবান বাস স্টেশনের গলির ভিতরে তাঁর বাসা ছিল যেন কর্মীদের জন্য এক মিলনকেন্দ্র। সেখানে আড্ডা, রাজনৈতিক পরিকল্পনা এবং অসংখ্যবার একসঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করার স্মৃতিগুলো মনে হলে এক গভীর আবেগ জাগে। জসিম ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শিক্ষা, সাহস আর অনুপ্রেরণার গল্প। তাঁর পরিশ্রম, নেতৃত্বগুণ আর সততার প্রতিচ্ছবি আমাদের কর্মদলকে প্রতিদিন নতুন করে সাহস জোগাত। যখনই কোনো সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে যেতাম, তিনি একদম কাছের মানুষের মতোই সেটা বুঝে সমাধান করার চেষ্টা করতেন। তাঁর আন্তরিকতা আর সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁকে আমাদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
আমি সৌভাগ্যবান যে, তাঁর নেতৃত্বে কাজ করতে পেরেছি। রাজনীতির পথচলায় তাঁর নিঃস্বার্থ পরামর্শ এবং দায়িত্ববোধ আমাকে যেমন অনুপ্রাণিত করেছে, তেমনি তাঁর জীবনের গল্প আমাকে আরও শক্তিশালী হতে শিখিয়েছে। তিনি কেবল একজন নেতা ছিলেন না, ছিলেন আমাদের পরিবারের একজন অভিভাবকের মতো। আমাদের একান্ত মুহূর্তগুলো, খাবারের টেবিলের আড্ডা কিংবা গভীর রাতের পরিকল্পনা, সবই যেন এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে গেছে।
এই স্মৃতিগুলো শুধুমাত্র আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, এটি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের একটি অংশ। জসিমউদদীন চৌধুরীর স্নেহময় ব্যক্তিত্বের ছায়ায় বেড়ে ওঠা সেই দিনগুলো আজও আমাকে তাড়া করে, অনুপ্রেরণা জোগায়।
রাউজানের রাজনীতিতে অধ্যাপক জসিম উদ্দিন চৌধুরীর নামটি ইতিহাসের পাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। আজ তিনি রাউজান বিএনপির দায়িত্বে এসে নতুন যুগের সূচনা করেছেন, কিন্তু তার রাজনৈতিক সংগ্রামের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। সেই শিকড়ের সাথে আমার এক গভীর আত্মীয়তা, স্মৃতির অতলে লুকিয়ে থাকা গল্প, আন্দোলনের দিনরাত্রি আর বন্ধুত্বের এক অটুট বন্ধন।সময়টা ছিল এরশাদের শাসনামল। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল, আর তারই এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি ছিলেন জসিম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি ছিলেন শুধু একজন মেধাবী ছাত্র নন, ছিলেন এক সাহসী নেতা। তার নেতৃত্বগুণ আর কর্মীদের প্রতি ভালোবাসা তখন থেকেই আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে তার গর্জন, গ্রেফতার হওয়া এবং মুক্তির দাবিতে আমাদের পোস্টারিং, মিছিল, মিটিং আজও আমার মনে গেঁথে আছে। তখন আমরা যারা তার অনুসারী ছিলাম, তারা তাকে শুধু নেতা হিসেবে নয়, একজন বড় ভাই এবং প্রেরণা হিসেবে দেখতাম। তার ধৈর্য, কর্মনিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল। তার পাশে থাকাটা ছিল আমার জন্য এক ধরনের গর্ব।
জসিম ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের প্রতিদিনের জমায়েতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মুরাদপুরের জনপ্রিয় হোটেল। সন্ধ্যা হলে শত শত কর্মী সেখানে এসে জমায়েত হতাম। সেই আড্ডায় রাজনৈতিক আলোচনা হতো, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হতো। জসিম ভাই ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র, তার প্রতিটি কথা আমাদের অনুপ্রাণিত করত। আমরা যেন এক পরিবারের মতো ছিলাম, যেখানে জসিম ভাই ছিলেন বড় ভাইয়ের ভূমিকায়।
তার সাথে কাটানো সেই সময়গুলো শুধু রাজনীতি নয়, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের এক গভীর বন্ধন তৈরি করেছিল। তার বড় ভাই, বিএনপির নেতা নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর সাথেও আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাদের বাড়িতে আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। কতবার যে আমরা সেখানে খেয়েছি, হিসাব করে বলা মুশকিল। তাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যই আমাদের আপনজন হয়ে উঠেছিল।
৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পরের সেই দিনগুলোর কথা এখনো স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কর্মীদের নিয়ে যখন আমরা
রাউজানের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, তখন নজরুলের চেরাগি পাহাড়ের বাসায় আক্রমণের ঘটনা আজও মনে আছে। কর্মীরা যখন উত্তেজিত হয়ে সেই বিল্ডিংয়ে আগুন দিতে চাইল, তখন জসিম ভাই সবাইকে শান্ত করে সরে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার সেই মানবিক সিদ্ধান্ত একটি বড় দুর্ঘটনা থেকে আমাদের রক্ষা করেছিল।
নুরুছাফা হত্যার ঘটনাটি আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। মন্টু ও জাফর সেই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল, অথচ পুলিশ অহেতুক জসিম ভাইকে হয়রানি করেছিল। এটি ছিল একটি চরম অন্যায়। নুরুছাফা ছিলেন জসিম ভাইয়ের অত্যন্ত আপন মানুষ। সেই দিনগুলোতে আমরা একসাথে লড়াই করেছি, অনেক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি। তবুও জসিম ভাই ছিলেন আমাদের মেরুদণ্ড, আমাদের অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস। রাজনীতির দীর্ঘ সংগ্রামের পর আজ জসিম ভাই একজন অধ্যাপক। তিনি পেশাগত জীবনে শিক্ষাকে বেছে নিলেও তার রাজনৈতিক আদর্শ আর নেতৃত্বগুণ আজও অটুট। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এনডিপি ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার সময় থেকে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তার নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা রাউজান বিএনপির জন্য আজও অপরিসীম।
আনোয়ার হোসেনের কথা না বললে এই স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তার বাসায় আমাদের যাতায়াত, তার সঙ্গে আড্ডা, এবং তার বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব সবসময় আমাদের কাছে একটি স্বস্তি ও শক্তি ছিল। তার সাথেও জসিম ভাইয়ের বন্ধন ছিল গভীর। তারা একসাথে দায়িত্ব পাওয়ার মাধ্যমে রাউজান বিএনপির রাজনীতি এখন নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।
অধ্যাপক জসিম উদ্দিন চৌধুরী আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার সঙ্গে কাটানো দিনগুলো শুধু রাজনীতি নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতায় ভরা। তার নেতৃত্ব, মানবিকতা, এবং সংগ্রামী মনোভাব চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তাকে একটি আলাদা জায়গায় নিয়ে গেছে।
আজ যখন তিনি আবার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, আমি আশা করি, তার নেতৃত্বে রাউজান বিএনপি নতুন করে পথ খুঁজে পাবে। অধ্যাপক জসিম উদ্দিন চৌধুরী ও মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন রাউজান বিএনপির নেতৃত্বে নতুন প্রত্যাশার আলো জ্বালিয়েছেন। নেতৃত্বের গভীরতা, মানবিকতা, এবং কর্মীদের প্রতি তাদের ভালোবাসা রাউজানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন দিশা দেখাবে। জসিম ভাইয়ের অভিজ্ঞতা ও দৃঢ় নেতৃত্ব এবং আনোয়ার ভাইয়ের কর্মীবান্ধব মনোভাব একসঙ্গে রাউজান বিএনপিকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে। তাদের প্রতি রাউজানের মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসা যেন সবসময় অটুট থাকে। আমি তাদের দীর্ঘ সফলতা ও সমৃদ্ধি কামনা করি। তাদের হাত ধরে রাউজানের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে—এ আশা রেখে শেষ করি।
জসিম ভাইয়ের প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তার এবং আনোয়ার ভাইয়ের সফলতা কামনা করছি- পাশাপাশি আমার কিছু রাজনৈতিক স্মৃতিময় কথা উপস্থাপন করছি-
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে আমরা বিএনপি ছাত্রদলের পক্ষ থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলাম। সে সময় বিএনপির মহাসচিব ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমান, যিনি তৎকালীন সময়ে দলের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিলেন। তবে এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ তৈরি হলে, বিএনপি দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। এই বিভক্তির পর ওবায়দুর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির অনেক অভিজ্ঞ নেতা বেরিয়ে এসে নতুন একটি দল গঠন করেন। এই দলটির নাম ছিল “বাংলাদেশ জনতা,” যার ছাত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় “বাংলাদেশ ছাত্র দল।”
আমি বাংলাদেশ ছাত্র দলের চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। আমাদের সভাপতি ছিলেন এস এম ফরিদ, আর তার আগে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন এম এ হাসেম রাজু। তিনি পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কমিটিতে যোগ দেওয়ায়, ফরিদ সভাপতি হন এবং আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিই। আমাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্র দল চট্টগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
এরপর, যখন কে এম ওবায়দুর রহমান পুনরায় বিএনপিতে ফিরে যান, তখন এম এ হাসেম রাজু ভাই বিএনপির ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি মনোনীত হন। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র ছিলেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
আমার নিজস্ব রাজনৈতিক যাত্রায়, লেখালেখি এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসি। এরপর “বাংলাদেশ বেকার পুনর্বাসন সংগ্রাম কমিটির” সভাপতি এবং “ছাত্র সংগ্রাম কমিটির” কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অধ্যায়টি ছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই আন্দোলনে কাজ করছি, যা আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
এখন আমি চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন ও নিয়মিত সাংবাদিকতা ও লেখা লেখি করে আসছি- ভবিষ্যতে এই নিয়ে আরও লিখব, আরও স্মৃতি ভাগাভাগি করব, ইনশাআল্লাহ।
লেখকঃ যুগ্ম সম্পাদক-দৈনিক ভোরের আওয়াজ ওThe Daily banner, গবেষক, এবং টেলিভিশন উপস্থাপক