বাটালি হিলের মেঠোপথে হাঁটতে গেলে সবার চোখে পড়ে এক চেনা মুখ—ইউনুস। তার দোকান বলতে ফ্লাস্কে ভরা চা, আর তার চলার পথই যেন সেই দোকানের আঙিনা। ভোর থেকে শুরু হয় তার দিন, শতায়ু অঙ্গনের শরীরচর্চাকারীদের চা পরিবেশন করেই তার সকাল জমে ওঠে।
কিন্তু ইউনুস শুধু চা বিক্রেতাই নন, তিনি বাটালি হিলের এক নিবেদিত সেবক। শতায়ু অঙ্গনের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে তিনি নিজের হাতে ঝাড়ু নিয়ে পরিষ্কার করেন, যেন প্রকৃতির সাথে মানুষের মিলনস্থলটি সবসময় সুশৃঙ্খল থাকে। এই কাজ তার কোনো দায়িত্ব নয়, এটি তার ভালোবাসা।
ইউনুসের চায়ের ফ্লাস্ক থেকে ছড়িয়ে পড়া উষ্ণতা যেমন ক্লান্ত পথিকদের সতেজ করে, তেমনই তার নিরলস পরিশ্রম আর সেবার মনোভাব প্রেরণা দেয় সবাইকে। সবার সঙ্গে তার হাসিমাখা মুখ আর আন্তরিক কথোপকথন বাটালি হিলের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করে। ইউনুস যেন সেই নিরব নায়ক, যার ছোট ছোট কাজগুলো প্রকৃতি আর মানবিকতার মাঝে এক গভীর বন্ধন তৈরি করে- আমি আজ সেই ইউনুসের না বলা জীবন কথার গল্প শুনাবো-
সকাল হয়েছে। শহর তখনো পুরোপুরি জাগেনি। শীতের কুয়াশায় মোড়া বাটালি হীল যেন এক নীরব শিল্পকর্ম। এমন শান্ত সকালে হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই দেখা মেলে একজন বৃদ্ধের। মলিন পোশাক, হাতে ঝাড়ু অথবা চায়ের ফ্লাস্ক। মাটির প্রতি মাথা নত করে তিনি কাজ করে চলেন। কপালে প্রশান্তি আর নিষ্ঠার ছাপ। লোকটির নাম ইউনুস। ইউনুস চাচা, যাকে শতায়ু অঙ্গনের সবাই এমন নামেই ডাকে। তার বয়স সত্তরের উপরে, তবুও জীবনের প্রতি এক অদ্ভুত আগ্রহ। এই বাটালি হীলের উচ্চতায় যেন তিনি এক অনন্য দৃশ্যের অংশ। প্রতিদিন সকালে শরীরচর্চা করতে আসা মানুষদের জন্য তার অবদান অসীম। ঝরা পাতার ভিড়ে রাস্তা পরিস্কার করা থেকে শুরু করে সদ্য রোপণ করা গাছে পানি দেওয়া—সবই তিনি করেন নীরবে।
কিন্তু কে এই ইউনুস? কেনই বা এই বয়সে তাকে এভাবে কাজ করতে হয়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মেলে এক সংগ্রামী জীবনের গল্প।
শুরু থেকে ইউনুস-
ইউনুসের শৈশব কেটেছে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার এক গ্রামে। কৃষিপ্রধান পরিবারে জন্ম তার। ছোট থেকেই দারিদ্র্যের কষাঘাতে বেড়ে ওঠা। বাবা-মায়ের অভাব পূরণের জন্য কৈশোরেই বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে। পড়ালেখা করার ইচ্ছা থাকলেও সেদিনের বাস্তবতা তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। পরিবারের উন্নতির আশায় যুবক বয়সে কাজের সন্ধানে চট্টগ্রামে পাড়ি জমান। জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে শেষে থিতু হন বাটালি হীলের পাদদেশে। তখন থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামের নতুন অধ্যায়।
বাটালি হীলের সঙ্গে সম্পর্ক-
প্রথমে চা বিক্রি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও বাটালি হীলের প্রতি ইউনুসের ভালোবাসা ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে। তিনি বলেন, “এই পাহাড়ের গাছ, পাখি, আর মানুষগুলো আমাকে আপন করে নিয়েছে। তাদের জন্য কিছু করতে পারলেই শান্তি পাই।” প্রায় বাইশ বছর ধরে ইউনুস এই পাহাড়ের পথে পথে চা বিক্রি করছেন। হাঁটতে হাঁটতে, গল্প করতে করতে চা পান করানোই যেন তার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এই কাজের মধ্যেই একদিন তিনি শতায়ু অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হন। শতায়ু অঙ্গন, যেখানে প্রতিদিন সকালবেলা স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ শরীরচর্চা করতে আসেন। তাদের সুবিধার্থে তিনি ঝাড়ু দিয়ে জায়গা পরিস্কার রাখেন। গাছপালা পরিচর্যা করেন। এ কাজের জন্য তিনি মাসিক ২৫০০ টাকা পান। কিন্তু টাকার জন্যই তিনি এই কাজ করেন না। এটা তার আত্মার তৃপ্তি। তিনি বলেন, “আমি এখানকার গাছপালাকে সন্তান মনে করি। এগুলো বড় হতে দেখলে নিজের সন্তানদের বেড়ে ওঠার মতো আনন্দ পাই।”
চা বিক্রেতা, সেবক ও কর্মী-
ইউনুসের কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য। সকালে তিনি ঝাড়ুদার, পরে মালির ভূমিকা পালন করেন। এরপর চায়ের ফ্লাস্ক হাতে নিয়ে তিনি হয়ে যান একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
তার চায়ের দোকান খুব সাধারণ। হাতে থাকা ফ্লাস্কই তার দোকান। তিনি বলেন, “আমি দোকান খুলে বসতে পারতাম, কিন্তু তাহলে বাটালি হীলের মানুষদের সঙ্গে দেখা হতো না। হাঁটতে হাঁটতে চা বিক্রি করি, এতে সবাইকে দেখি, কথা বলি।” দিনে তার আয় হয় ২০০-৩০০ টাকা।
পরিবারের গল্প-
ইউনুসের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়েরা বিবাহিত, নিজের
সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বড় ছেলে বিবাহের পর আলাদা হয়ে গেছে। ছোট ছেলে এখনো তার সঙ্গেই থাকে। স্ত্রীও বেঁচে আছেন, তবে শরীর ভালো নয়।
তবে বড় ছেলের অবহেলা ইউনুসকে কষ্ট দেয়। তিনি বলেন, “যে ছেলেকে বড় করতে এত কষ্ট করলাম, সে আজ মায়ের-বাবার খবর রাখে না। ছোট ছেলেকে নিয়েই এখন দিন কাটে। কিন্তু কে জানে, একদিন সেও আলাদা হয়ে যাবে।”
তার এই ভবিষ্যতের আশঙ্কা তার চোখে জল এনে দেয়। বৃদ্ধ বয়সে নিজেকে আর কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, এ নিয়েও তিনি চিন্তিত।
ইউনুসের সংগ্রাম ও স্বপ্ন-
ইউনুসের জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার সংগ্রামী মানসিকতা। তিনি কখনো বড় কিছু চাননি। তার চাওয়া, শুধু শান্তিতে থাকা।
তিনি বলেন, “আমার কোনো গাড়ি-বাড়ির স্বপ্ন নেই। আল্লাহ যতদিন চলার শক্তি দিয়েছেন, ততদিন কাজ করব।”
তার সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কাজ করার ক্ষমতা কমে আসছে। “যদি একদিন কাজ করার শক্তি হারাই, তখন কী হবে? কে দেখবে আমাকে আর আমার স্ত্রীকে?”
শতায়ু অঙ্গনের ভালোবাসা-
বাটালি হীলের শতায়ু অঙ্গনের মানুষরা ইউনুসকে খুব ভালোবাসেন। তার পরিশ্রমের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। কেউ কেউ তাকে হাতখরচ দেন, কেউ আবার তার চা পান করে খুশি হন।
ইউনুস বলেন, “এই মানুষগুলো আমার পরিবার। এদের ভালোবাসা ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ।”
ইউনুসের জীবনের বার্তা-
ইউনুসের জীবন থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। তার পরিশ্রম, ত্যাগ, এবং অল্পতে খুশি থাকার মানসিকতা আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। বাটালি হীলের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঝরা পাতা যেন ইউনুসের জীবনের গল্প বলে। তার সেবা, তার ত্যাগ একদিন হয়তো ভুলে যাবে মানুষ। কিন্তু এই পাহাড়ের গাছপালা হয়তো তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।ইউনুসের জীবন এক নিঃসঙ্গ সংগ্রামের গল্প। তার পরিশ্রম আর ভালোবাসা বাটালি হীলকে জীবন্ত করে তুলেছে। এমন মানুষদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকা উচিত। ইউনুসের মতো মানুষেরা আমাদের শেখায়, জীবনের প্রকৃত সার্থকতা বড় কিছু অর্জনে নয়; বরং মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য কাজ করার মধ্যেই।
ইউনুসের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের শিখিয়ে যায়, ছোট কাজেও বড় হৃদয় থাকা যায়। তার চুপচাপ সেবা, নিঃস্বার্থ পরিশ্রম আর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে মানবতার নিভৃত প্রাঙ্গণে। তার মতো মানুষরা প্রমাণ করে, পৃথিবী বদলানোর জন্য বড় কিছু নয়, দরকার শুধু নিষ্ঠা, ভালোবাসা আর অপরিসীম আত্মত্যাগ