বিস্মৃত এক আলোকশিখা
সময় বহমান, স্মৃতির পাতায় ধুলো জমে, কালের স্রোতে হারিয়ে যায় অনেক নাম। কিন্তু কিছু নক্ষত্র থাকে, যারা আপন আলোয় চিরকাল দীপ্তমান—যেমন ছিলেন ফাহমিদা আমিন।
১১ জানুয়ারি তাঁর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী নীরবতার আবরণে ঢাকা পড়ে গেল। ১৬ জানুয়ারি ছিল তাঁর ৯০তম জন্মদিন—কিন্তু কোথাও কোনো আয়োজন, কোনো স্মরণসভা, কোনো শ্রদ্ধার্ঘ্য নেই। আমরা, যারা নিজেদের লেখক-সাহিত্যিক বলে পরিচয় দেই, আজ লজ্জিত। আমরা কি সত্যিই একজন গুণী লেখিকাকে যথাযথভাবে স্মরণ করতে পেরেছি?
ফাহমিদা আমিন কেবল একজন সাহিত্যিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন বাংলা রম্যসাহিত্যের এক দীপ্ত নক্ষত্র, যাঁর লেখায় ছিল সমাজের প্রতিচিত্র, ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরস, জীবনবোধের গভীরতা। তিনি হাসাতেন, কাঁদাতেন, ভাবাতেন—তবু আমরা তাঁকে ভুলে গেলাম!
সমাজের আয়না ধরে রাখা এই মহীয়সী সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিনে যদি আমরা তাঁকে ভুলে যাই, তবে আমাদের কলমের কী মূল্য থাকে? বাংলা সাহিত্যের প্রতি, গুণীজনদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার অবস্থান কোথায়?
সম্মান জানাই, শ্রদ্ধা জানাই, প্রার্থনা করি—তাঁর সৃষ্টিগুলো নতুন করে পাঠকের কাছে ফিরে আসুক। তাঁর স্মৃতি যেন কেবল কিছু পুরোনো পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি হয়ে উঠুন অনুপ্রেরণার এক অমলিন অধ্যায়।
শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে আমি ফাহমিদা আমিনকে নিয়ে এই লেখাটি লিখলাম –
বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন সাহিত্যিক ফাহমিদা আমিন। রম্যসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ, সমাজসেবী, সংগঠক ও সফল নারী হিসেবে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি এবং সমাজের বাস্তব চিত্রকে গভীরভাবে তুলে ধরার দক্ষতায় তিনি বাংলা রম্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর লেখনী যেমন পাঠককে হাসিয়েছে, তেমনি কখনো গভীর আবেগে আপ্লুতও করেছে।
আজ সেই সাহিত্যিক চিরবিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
এক জীবন—সাহিত্যের জন্য উৎসর্গিত ফাহমিদা আমিন ১৯৩৬ সালের ১৬ জানুয়ারি খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রয়াত বিজ্ঞানী ড. এম. আর. আমিনের সহধর্মিণী। এই দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এনশাদ ইবনে আমিন ২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ হন।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন তাঁর বিয়ে হলেও তিনি সংসারের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর (এম. এ.) ডিগ্রি লাভ করেন। রত্নগর্ভা মা হিসেবে তিনি শুধু সন্তানদের সুশিক্ষিত করেই থেমে থাকেননি; নিজেও এক মহান শিক্ষার্থী ছিলেন।
ফাহমিদা আমিন চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। নারী সমাজের উন্নয়ন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রসারে তিনি ছিলেন নিরলস। তিনি চট্টগ্রামের রোকেয়া নামে পরিচিত ছিলেন, কারণ তাঁর জীবন ও কাজ নারীদের মুক্তির পথে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
সাহিত্যজীবন ও অবদান ফাহমিদা আমিনের লেখনীর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তীক্ষ্ণ রসবোধ, সামাজিক ব্যঙ্গ এবং গভীর জীবনবোধ। রম্যরচনা থেকে গল্প, কবিতা, শিশুতোষ সাহিত্য, ছড়া, স্মৃতিকথা—সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর লেখায় যেমন হাস্যরস ছিল, তেমনি ছিল ব্যঙ্গ ও শ্লেষের মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরার ক্ষমতা। তিনি ছিলেন বাংলা রম্যসাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর রচনায় সমাজের নানা বৈপরীত্য ফুটে উঠেছে, কখনো রসিকতায়, কখনো বা করুণ বাস্তবতায়। তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, সুনিপুণ ও হৃদয়গ্রাহী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে শ্রোতারা নীরব হয়ে তাঁর প্রতিটি বাক্য শুনতেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—নিমমধু
অনিবার্য কারণবশত
মনের আঙ্গিনায়,
মৌ ঝুর ঝুর,
বার্মিংহাম থেকে লিখছি,
করাচি প্রবাসে,
রঙে রঙে বোনা,
প্রজাপতি রং ছড়ায়
ঝালে ঝোলে অম্বলে
তাঁর রচনা শুধুমাত্র দেশে নয়, বিদেশেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর রম্যরচনা, গল্প ও কবিতার মধ্যে সমাজের এক বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
আমার সাহিত্যিক পথচলায় তাঁর অনুপ্রেরণা
ফাহমিদা আমিনের সঙ্গে আমার সাহিত্যিক সম্পর্ক বহু পুরনো। তাঁর লেখা যেখানে পেতাম, সেখান থেকেই পড়ে ফেলতাম। তাঁর লেখার গভীরতা, তথ্যনিষ্ঠতা এবং ভাষার সাবলীলতা আমাকে মুগ্ধ করত। ২০০২ সালের ২৮ জুন শৈলী প্রকাশনের আয়োজনে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে এক সাহিত্য কর্মশালায় তাঁর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক আলী ইমামসহ অনেক বরেণ্য লেখক উপস্থিত ছিলেন। তখন থেকেই আমি তাঁকে আরও নিবিড়ভাবে অনুসরণ করতে থাকি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাহিত্য আসর, বইমেলা ও সাহিত্য অনুষ্ঠানে তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় ছিল, শৈলী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আমার লেখা “নারী কথা” ও “টক্টক্ কথা” প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তাঁকে আনতে পারা। তিনি আমার লেখা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে উৎসাহ দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন এবং বলেছেন, “একজন লেখককে প্রচুর পড়তে হয়। লেখালেখির জন্য পড়াশোনার বিকল্প নেই।” তাঁর প্রতিটি লেখা আমার জন্য এক অনন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে।শেষ বিদায়: এক নক্ষত্রের পতন
২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর অবদান অপরিসীম, যা কখনো ম্লান হবে না। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা রম্যসাহিত্য এক অনন্য প্রতিভাকে হারিয়েছে, যার শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। ১১ই জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী অতিবাহিত হয়েছে, আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তিনি চলে গেলেও তাঁর সাহিত্য চিরকাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে, অনুপ্রেরণা জোগাবে, পথ দেখাবে।
আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই মহান সাহিত্যিককে, যিনি আমাদের হাসিয়েছেন, ভাবিয়েছেন, সমাজকে সচেতন করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
শ্রদ্ধাঞ্জলি, ফাহমিদা আমিন।