চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল রিয়ারভিউ এলাকায় জমি দখল সংক্রান্ত বিরোধের জেরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন। হামলার পর ২৭ ডিসেম্বর বোয়ালখালী থানায় একটি সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের করা হয়। স্থানীয়ভাবে উত্তেজনা বিরাজ করায় পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দীর্ঘদিনের জমি বিরোধ: স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে ১৫ গন্ডা জায়গা নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। জমিটি নিয়ে স্থানীয় দুই পরিবারের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। বিরোধপূর্ণ জমির বিষয়ে একাধিকবার স্থানীয়ভাবে সালিশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও কোনো সমাধান হয়নি। এক পক্ষ দাবি করে, তারা দীর্ঘদিন ধরে জায়গাটি দখল করে বসবাস করছেন এবং সেখানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছেন। অপরপক্ষের দাবি, জমির প্রকৃত মালিক তারা এবং ভুয়া দলিল দেখিয়ে প্রতিপক্ষ অবৈধভাবে জমি দখল করেছে। জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ইতোমধ্যে দেওয়ানী আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে। জমির মালিকরা আদালতে ১৪৫ ধারায় নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন এবং পুলিশকে তা কার্যকর করার নির্দেশনা দেন।
ঘটনার সূত্রপাত: ২৫ ডিসেম্বর রাতে, জমির মালিক পক্ষের অভিযোগ, প্রতিপক্ষ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জমিতে রাতের আঁধারে ঘর নির্মাণের চেষ্টা চালায়। বিষয়টি টের পেয়ে জমির মালিকরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুই পক্ষ লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে একে অপরের ওপর হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। হামলার শিকার এক পক্ষের দাবি, প্রতিপক্ষের লোকজন অতর্কিতে হামলা চালিয়ে তাদের গুরুতর আহত করে এবং বসতবাড়ি ভাঙচুর করে। থানায় মামলা ও পাল্টা অভিযোগ: সংঘর্ষের পর, আহত পক্ষের একজন বোয়ালখালী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে জমি দখল, হামলা এবং হত্যার হুমকির অভিযোগ আনা হয়। অপরপক্ষও হামলার শিকার হয়েছেন দাবি করে আদালতে পাল্টা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। স্থানীয়রা জানান, জমি দখল ও বিরোধের বিষয়টি বেশ পুরনো হলেও সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিকবার থানায় জিডি করেছেন, তবে কার্যকর কোনো সমাধান হয়নি। পোস্টার টাঙানোর অভিযোগ:
এই ঘটনার পর, এলাকায় আসামিদের ছবি সংবলিত পোস্টার টাঙানোর অভিযোগ উঠেছে। পোস্টারে তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং স্থানীয় জনগণকে তাদের থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানানো হয়। এতে আসামিরা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন এবং তারা মানহানির অভিযোগ এনে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এ বিষয়ে এক আসামির বক্তব্য, “আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ঠিক, কিন্তু আদালত এখনো কোনো রায় দেননি। তার আগেই আমাদের বিরুদ্ধে এভাবে পোস্টার টাঙানো অন্যায় এবং মানহানিকর।” অন্যদিকে, ভুক্তভোগী পক্ষ দাবি করেন, “আমরা জমির বৈধ মালিক। বারবার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় বাধ্য হয়ে আমরা স্থানীয়দের জানাতে পোস্টার লাগিয়েছি। এতে তাদের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে মাত্র।”
আইনি প্রতিকার: এ বিষয়ে আইনজীবীরা জানান, কারো বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকলেও আদালতে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে তাকে অপরাধী হিসেবে প্রচার করা আইনসম্মত নয়। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৯৯ ও ৫০০ ধারায় মানহানির জন্য দোষী প্রমাণিত হলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
আইনজীবী মো. আলী হোসেন বলেন, “যদি কেউ পোস্টারের মাধ্যমে কাউকে অপরাধী হিসেবে প্রকাশ করে এবং আদালত তা প্রমাণ না করে, তাহলে এটি স্পষ্টতই মানহানির শামিল। এ ধরনের ঘটনায় আদালতে মানহানির মামলা দায়ের করা যেতে পারে।” পুলিশের ভূমিকা:
বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, “ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চলছে এবং দুই পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ করা হচ্ছে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “স্থানীয়দের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে আমরা উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করছি। আদালতের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোনো পক্ষ যেন নিজের হাতে আইন তুলে না নেয়, সে বিষয়ে কঠোর নজর রাখা হচ্ছে।”
স্থানীয় উত্তেজনা: এই জমি বিরোধ এবং পোস্টার টাঙানোর ঘটনায় বোয়ালখালীতে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে, ফলে অনেকেই বাইরে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল করিম বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় বসবাস করছি। জমি নিয়ে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এখন প্রতিদিন নতুন নতুন ঝামেলা দেখা দিচ্ছে।”
ভুক্তভোগীদের আবেদন:
ভুক্তভোগী পরিবার এবং স্থানীয়রা প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তাদের দাবি, যেন আদালতের রায় কার্যকর করে প্রকৃত মালিকদের জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এলাকাবাসীর দাবি, এ ধরনের বিরোধ যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সে জন্য প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে এবং স্থানীয়ভাবে ভূমি বিরোধ নিরসনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে সংঘর্ষ ও পোস্টার টাঙানোর ঘটনা বোয়ালখালীতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। আদালতের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে যে কোনো ধরনের প্রচারণা বা অপপ্রচার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ—এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইনজীবীরা।