ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের জীবনের স্বপ্ন ছিল সরল, কিন্তু তার প্রতিটি স্তরে ছিল এক অপার ভালোবাসার ছোঁয়া। একটি খাতার পৃষ্ঠায় রাসেল লিখেছিল: “আমার একটি ফুলের বাগান আছে। লাল, সাদা, বেগুনি, গুলাপি, হলুদ, কালো…”। নানা রঙের ফুলের মতো তার কল্পনা ছিল মিষ্টি, নিখাদ। তার সেই বাগান যেন জীবনের প্রতিটি রঙে ভরে উঠেছিল—খেলাধুলা, পড়াশোনা, আর পরিবারের ভালোবাসায়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের সেই কালরাতে সবকিছু বদলে গেল। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে শেখ রাসেলের স্বপ্নও ধ্বংস করে দিল দেশদ্রোহী ঘাতক চক্র। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রাসেলের প্রিয় বাগানের জায়গায় এখনো ফুল ফুটে, পাখি ডাকে, মানুষ আসে শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু রাসেল সেখানে নেই। তাঁর সেই সরল হাসি, উচ্ছ্বল শিশুকাল, আর মায়ের কোলে গা এলিয়ে দেওয়া মুহূর্তগুলো সবই যেন হারিয়ে গেছে।
আজ ১৮ অক্টোবর, শেখ রাসেলের জন্মদিন। যদি সেই মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটত, তবে রাসেল হয়তো আজ ৫৮ বছরে পা দিত। তিনি হয়তো আজ একজন সফল বাগানবিলাসী হতেন, প্রতিটি কোণায় হাসি আর খুশির বাগান ছড়িয়ে দিতেন। কিন্তু তা আর হলো না। তাঁর শৈশব কেটেছে শেখ মুজিবের অমায়িক স্নেহ আর মা রেনুর ভালোবাসায় ভরে। তার স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধরে আছে বঙ্গবন্ধু ভবন। সেখানে রয়েছে তার ছোট্ট সাইকেল, নিজের হাতে লেখা খাতা, আর তার সংগ্রহ করা ডাকটিকেটের বক্স, যা তার স্বপ্নকে জানান দেয়। রাসেল ছিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র। সে ভালোবাসতো কল্পনা করতে—খাতার পাতায় ফুলের বাগান আঁকতে। কোরিয়া, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেট তার সংগ্রহে ছিল, যা ভবিষ্যতে অনেক বড় কিছুর ভিত্তি হতে পারতো। কিন্তু তার কল্পনার জগৎ সেই ভয়াল রাতে চিরতরে থেমে গেল। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর সেই রাতে শুধু বঙ্গবন্ধুকেই নয়, রাসেলকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার শেষ ইচ্ছা ছিল মায়ের কাছে যাওয়ার। সে কেঁদে বলেছিল, “আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো।” একজন পুলিশ কর্মকর্তা ঘাতকদের অনুরোধ করেছিলেন শিশুটির জীবন রক্ষা করতে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর নির্বিকার রয়ে যায় তাদের সামনে। রাসেলের এক হাতে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে ভিক্ষা চেয়েছিল, “আমার জীবনটা দাও,” কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরও নিষ্ঠুর ঘাতকদের হৃদয় ছুঁতে পারেনি। আজ শেখ রাসেলের জন্মদিনে, এই শোকের স্মৃতিচিহ্ন আমাদের কাঁদায়, তবুও আমাদের স্বপ্ন সেই আলোয় পথ খোঁজে যেখানে আর কোনো শিশুকে এমন নিষ্ঠুরতার শিকার হতে না হয়। একটি মানবিক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার যে দায়িত্ব আমাদের কাঁধে আছে, আজকের দিনে তা আরও বেশি করে অনুভূত হয়। শেখ রাসেলের স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। কবি ফারুক মাহমুদের কথায় যেন প্রতিবাদ অনুরণিত হয় প্রতিটি হৃদয়ে: “শিশুরা চাঁদের মতো নির্দোষ তাই, যে-হোক, সে-হোক আমি শিশু হত্যার বিচার চাই, আমি রাসেল হত্যার বিচার চাই।”
আজকের দিনটি যেন আমাদের প্রত্যেককে শেখ রাসেলের সেই চিরন্তন সরলতা আর ভালোবাসার স্মৃতি জাগ্রত করে রাখে। আমাদের এই গল্পের শিশুটি যেখানেই থাক, তার আত্মা যেন শান্তি পায়, এবং আমরা যেন একটি মানবিক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ গড়তে পারি। শেখ রাসেলের স্মৃতিতে আমরা শুধু শোক প্রকাশ করি না, বরং তার জীবনের করুণ পরিণতি আমাদেরকে শিশুদের নিরাপত্তা ও ভালোবাসার সাথে সংযুক্ত থাকার অনুপ্রেরণা দেয়। আগামী দিনের প্রতিটি শিশু যেন তার স্বপ্নের বাগানে নিরাপদে খেলা করতে পারে, এমন একটি সমাজ গড়ে তোলার সংকল্প নেওয়া আমাদের কর্তব্য।
আমাদের শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে, শেখ রাসেলের জীবনের ঘটনা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়—কখনো যেন সহিংসতার ছায়া তাদের নিষ্পাপ হৃদয়ে পৌঁছাতে না পারে। শিশুরা তাদের কল্পনার পৃথিবী গড়বে, আনন্দে ভরে উঠবে তাদের মন। শেখ রাসেলের মতো আর কোনো শিশুকে হারানোর বেদনা যেন না আসে, সেই লক্ষ্যেই আমাদের এই চেতনা জাগ্রত হোক। রাসেলের অব্যক্ত গল্প এবং তার ছোট্ট খাতার পাতায় আঁকা কল্পনার বাগান যেন আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিটি শিশুই একটি ফুলের মতো, যার যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক