জোবায়েদার হঠাৎ ফোন। অনেকদিন পর তার কণ্ঠ শুনে মন যেন কেমন করে উঠল। তাকে বললাম, চলে আসতে আমার অফিসে। আমাদের অফিস দুটো পাশাপাশি হলেও বহুদিন ধরে দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। অথচ আজ হঠাৎ তার এই ফোন—জানা গেল, সামিরা নামের এক তরুণীর প্রেমঘটিত জীবনাবসানের ওপর আমার লেখা তার চোখে পড়েছে, এবং তাতে কিছুটা নাড়া লেগেছে তার মনেও।আমি ভাবলাম, কিছুটা সময় তার অজানা, অনুচ্চারিত কথাগুলো শোনার জন্য আজকের বিকেলটা দিই। তার সাথে কথা হয়েছিল বহু আগে, তার জীবনকথা লিখবো বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম একদিন। আজ সেই কথার টানে তাকে নিয়ে এই লেখায় ডুব দিলাম, তার জীবনের রঙ-রেখা বুনতে বসলাম।
সন্ধ্যার আলো নিবু নিবু। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে জোবায়েদা একা বসে আছে তার ছোট্ট বারান্দায়। সারা জীবনের হিসাবের খাতা যেন আজ তার সামনে খুলে বসেছে। বয়সের ভারে নয়, বরং জীবনের অভিজ্ঞতায় ক্ষতবিক্ষত তার মন। একসময় ভালোবাসার স্বপ্নে বিভোর ছিল সে, বিশ্বাস করেছিল জীবনসঙ্গীর পাশে দাঁড়িয়ে এক সুস্থির জীবন কাটাবে। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো ভেঙে গেছে বারবার, প্রতারিত হয়েছে বারংবার।
জোবায়েদা বলেন, “পুরুষের চোখে যেন সব নারী এক কাঁচের টুকরো, যা সহজেই ভাঙা যায়। তারা আসে, একটু মায়া দেখায়, আর তারপর হারিয়ে যায়। হয়তো ভাবে, নারী মানেই দুর্বল, মানেই তাদের নিঃস্বার্থ সঙ্গী হয়ে সব মেনে নেওয়া।”
তার প্রথম জীবনের প্রেম ছিল রবি(কাল্পনিক নাম)। সে ছিল এক উচ্ছ্বাসে ভরা যুবক, প্রতিটি কথায় মিষ্টি মধুর ছোঁয়া। জোবায়েদা রবিকে কেন্দ্র করে তার জীবনকে সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু রবি তাকে একদিন ছেড়ে চলে যায়, নিঃশব্দে, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। তখনই জোবায়েদা প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করেছিল, হয়তো সে কখনো সত্যিকার ভালোবাসা পায়নি, বরং শুধু একজন পুরুষের স্বার্থের ফাঁদে আটকে ছিল।
কিন্তু এরপরেও থেমে যায়নি তার জীবন। জোবায়েদা ভেবেছিল, হয়তো এই এক ব্যর্থতা তার জীবনের উপসংহার নয়। আবার কেউ আসবে, এই বিশ্বাসে সে এগিয়ে চলে। একের পর এক মানুষের সাথে মিশে, কথা বলে, কিন্তু প্রতিবারই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটে।একদিন সে এক বন্ধুর কাছে অভিযোগ করে, “সবাই আসে, নিজের সুবিধার জন্য। নারীকে কখনো কেউ সম্মানের চোখে দেখে না। আর যদি কিছু দিতে না পারো, তবে তাদের মনোযোগ ধরে রাখারও প্রয়োজন নেই।” তার বন্ধুটি উত্তর দেয়, “তুমি কেন নিজেই নিজের কাছে পরিপূর্ণ হতে চাও না? কেন এমন কাউকে খুঁজছো যার ওপর নির্ভর করা যায়?”এই প্রশ্নটি জোবায়েদাকে ভাবিয়ে তোলে। সে বুঝতে পারে, জীবনের পথ তার একারই। যারা আসে তারা আসে নিজের স্বার্থে, নিজেদের শর্তে। তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আর কারো ওপর নির্ভর করবে না, আর নিজের শক্তিকেই সে তার প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করবে।সেই রাত থেকে জোবায়েদা নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পায়। সে নিজের জন্যই বাঁচতে শুরু করে। তার পাশে কেউ নেই, কেউ তার কান্না দেখবে না। কিন্তু সে আজকাল আর অশ্রুতে ভেসে যায় না।এই একাকীত্বই আজ তার প্রেরণা হয়ে উঠেছে। একদিন বারান্দার সিঁড়িতে বসে আকাশের দিকে চেয়ে সে বলে, “আমার জীবন আমি নিজেই, আমার যন্ত্রণা, আমার সুখ, সব আমার। কেউ আমাকে দেয়নি, আর কেউ তা নিতে পারবেও না। আমি নিজেই আমার ছায়া, আর আমিই আমার সঙ্গী।”জোবায়েদার সেই একাকীত্ব আজ তার কষ্ট নয় বরং তার শক্তি। তার চারপাশে যে ছায়াগুলো তৈরি হয়েছে, তা সে নিজেই গড়েছে, সুরক্ষার জন্য, নিজেকে ঘিরে রাখার জন্য। জীবনের কঠোরতা তাকে ভেঙে দেয়নি, বরং সে তার নিজের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। মেকি ভালোবাসার ফাঁদে
জোবায়েদার জীবনে পুরুষেরা এসেছে, আর চলে গেছে। এক সময় সে বিশ্বাস করত, ভালোবাসা হলো জীবনের আশ্রয়, যেখানে একজন মানুষ তার সমস্ত কষ্ট, দুঃখ, আনন্দ, সবকিছুই ভাগাভাগি করে নিতে পারে। কিন্তু আজ তার জীবনের অভিজ্ঞতা যেন তাকে অন্য এক সত্য শিখিয়ে দিয়েছে। সে জানে এখন, ভালোবাসার নামে অনেকে আসে, মুখে মিষ্টি কথা বলে, কিন্তু আসলে তাদের অন্তরে কোনো সত্যিকার স্নেহ নেই।
জোবায়েদা বলেন, “পুরুষেরা কেন নারীদের ভালোবাসার নাম করে ফাঁকি দেয়? তাদের কি সত্যিই অনুভূতি নেই? প্রতিবার তারা এসে ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে রাখে, আর তারপর হঠাৎ করে দূরে সরে যায়। তাদের এই মেকি ভালোবাসা যেন নারীকে খেলার পুতুলে পরিণত করে।”
এক সময় তারও একজন ভালোবাসার মানুষ ছিল। সে ভেবেছিল, সেই মানুষই তার জীবনের সব সুখের উৎস হবে। কিন্তু সেই ভালোবাসার মানুষ তার জীবন থেকে চলে যায়, আর রেখে যায় অবিশ্বাসের গভীর ক্ষত। জোবায়েদা তখন বুঝতে পেরেছিল, তার চারপাশের ভালোবাসা মানে নিছকই প্রতারণা।
তারপর সে সন্তান হারা মায়েদের সাথে মিলে নিজেদের দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করল। একদিন এক মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে সে শুনল, কীভাবে তার ছেলে তাকে ছেড়ে চলে গেছে, সারা জীবন যার জন্য সে লড়াই করেছিল। সেই মায়ের আহাজারি শুনে জোবায়েদার মনে হল, ভালোবাসা মানেই শুধু সঙ্গী নয়; সন্তানও একধরনের স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্নও কখনো মিথ্যা হতে পারে। জোবায়েদা বলে, “একটি মায়ের বুকের মধ্যে সন্তানের জন্য যে কষ্ট থাকে, তা আমি খুব ভালো বুঝি। আমি জানি কীভাবে একটি মেয়ে প্রতারিত হয়, আর কীভাবে একজন মা তার সন্তানের জন্য নিঃস্ব হয়ে যায়। ভালোবাসার নামে এই যে খেলা, তা কেবলমাত্র কষ্টই বাড়ায়।” আজ জোবায়েদা আর কাউকে বিশ্বাস করে না। সে বলে, “ভালোবাসা তো শুধুই নাম, আসলে কিছুই না। সবার মনে শুধু নিজস্ব স্বার্থ থাকে, নিজের প্রয়োজন। নারীদের সরলতার সুযোগ নিতে পুরুষেরা শুধু মিথ্যে আশ্বাস দেয়, আর মেয়েরা সেই ফাঁদে পড়ে যায়।”
কিন্তু এত কষ্টের মাঝেও জোবায়েদা নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলেছে। সে বিশ্বাস করে, নারীরা যদি নিজেদের আত্মশক্তিকে উপলব্ধি করতে পারে, তবে তারা আর কারো অপেক্ষায় থাকবে না। সে আজ বলতে পারে, “আমি আর কারো মেকি ভালোবাসা চাই না। আমার নিজের জন্যই আমি যথেষ্ট।”
জীবনের প্রতিটি প্রান্তে যেসব কষ্ট সে সয়ে গেছে, সেগুলো তাকে শক্তি যুগিয়েছে। সে আজ জানে, ভালোবাসার মায়া না খুঁজে, নিজের ভেতরের শান্তিকে খুঁজে নেওয়াই জীবনের প্রকৃত অর্থ। জোবায়েদা নিজের মতো করেই জীবন কাটাচ্ছে, পুরুষের প্রতারণার মিথ্যে গল্প থেকে অনেক দূরে। আজ সে কারো প্রতিশ্রুতির অপেক্ষায় নেই, বরং নিজের ভেতরেই নিজের আসল শান্তি খুঁজে নিয়েছে।
চলবে–
লেখাকঃ সাংবাদিক, গবেষক ও টেলিভিশন উপস্থাপক।