1. mail.bizindex@gmail.com : newsroom :
  2. info@www.bhorerawaj.com : দৈনিক ভোরের আওয়াজ :
শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ০৭:১৩ অপরাহ্ন
সর্বশেষ :
শেষ হলো দাওয়াতে ইসলামীর তিনদিনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় ইজতেমা বালুকাবেলার আত্মঘোষণা: যেখানে সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের কবিতা চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের ঐক্য উৎসব পারকি সৈকতে গড়লো অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু মাওলানা রইস উদ্দিন হত্যার বিচার দাবিতে আনোয়ারায় বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ! “বাঁশখালীতে ৪ হাজার ইয়াবাসহ টেকনাফের মাদক কারবারি আটক: ব্যবহৃত মোটরসাইকেল জব্দ” হোমনায় মহান মে দিবস উপলক্ষে  বিএনপির বর্ণাঢ্য র‍্যালি  ড. মোহাম্মদ ইউনূস এর শুভ আগমনে বোয়ালখালীবাসীর পক্ষ থেকে হাজী মোহাম্মদ আলম ববির শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা পুলিশ পরিচয়ে ঘরে প্রবেশ করে পরিবারের ৮ জনকে বেঁধে ছয়টি দোকান ঘর গুঁড়িয়ে দিয়ে মালামাল লুট করেছে দুর্বৃত্তরা রোদেলা দুপুরে পারকি সৈকতের বালুকাবেলায় কলম যোদ্ধারা,স্মৃতিময় এক মে দিবস! ড. মোহাম্মদ ইউনূসের দক্ষিণ চট্টগ্রাম সফর

ফজলে করিমের অপরাধ কাহিনি এক অপরাধ সাম্রাজ্যের গল্প

মো. কামাল উদ্দিন
  • প্রকাশিত: শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ১৬৫ বার পড়া হয়েছে

ফজলে করিম, বাংলাদেশের অপরাধের অন্ধকার দুনিয়ার এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা অপরাধ, দুর্নীতি ও সমাজে অস্থিরতার গল্প। একজন অপরাধী হিসেবে তার খ্যাতি শুধুমাত্র অপরাধের সীমা ছাড়িয়ে গেছে; সে হয়ে উঠেছে এক সম্রাট, যার হাতে নাড়া দিয়েছে অসংখ্য জীবনের নিয়ম।

ফজলে করিমের কর্মকাণ্ড নিয়ে নির্মিত হবে কয়েকটি সিনেমা, যা তার জীবনের অজানা অধ্যায়গুলোকে প্রকাশ করবে। এই সিনেমাগুলোতে তুলে ধরা হবে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক, পুলিশি সহায়তা এবং সন্ত্রাসের জাল, যা তার অপরাধ সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করেছে।

এছাড়াও, তার জীবন নিয়ে লেখা হবে সিরিজ এবং উপন্যাস, যা কেবল তার অপরাধের ইতিহাস নয়, বরং সেইসব মানুষের গল্পও বলবে যারা তার জাল থেকে মুক্তির চেষ্টা করছে। ফজলে করিমের অপরাধ কাহিনির বিভিন্ন দিক, যা আজও সমাজে প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।

এভাবে, ফজলে করিমের অপরাধের কাহিনি কেবল একটি ব্যক্তির গল্প নয়, বরং একটি সমাজের অন্ধকার দিকের প্রতিচ্ছবি।

সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়েছে।১৯সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি চট্টগ্রাম মহানগরের দামপাড়া পুলিশ লাইনস মাঠে অবতরণ করে। চট্টগ্রামে আসার পরপরই কড়া র‍্যাব ও পুলিশের পাহারায় তাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী তৎপর ছিল যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে।

এই ঘটনাটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে গত ১২ সেপ্টেম্বর, যখন ফজলে করিম চৌধুরী এবং আরও দুজন আখাউড়া সীমান্ত এলাকা থেকে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের চেষ্টাকালে বিজিবির হাতে আটক হন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আখাউড়ার নূরপুর এলাকার সাবেক মেম্বার মো. হান্নান মোল্লা এবং স্থানীয় বাসিন্দা মো. নাঈম চৌধুরী। আটক হওয়ার পর বিজিবি জানায়, তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাদের আটক করার পর বিজিবি আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় ফজলে করিমকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে প্রেরণ করা হয়, এবং পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়।

ফজলে করিম চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনি এই আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং দীর্ঘদিন ধরে রাউজান এলাকায় তার প্রভাব ছিল। তবে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর, ফজলে করিমের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার জটিলতায় পড়ে। সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক কার্যক্রম।

চট্টগ্রামে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সরকারি তহবিলের অপব্যবহার এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কিত অভিযোগ। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে যে তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তার বিরুদ্ধে রাউজান এলাকায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকারি প্রকল্পের অর্থ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও উঠে। এই বিষয়গুলো নিয়ে রাউজানের জনগণ এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ মহলেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এর আগে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ফজলে করিমকে চট্টগ্রাম আদালতে তোলার কথা ছিল। চট্টগ্রামের রাউজানসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তার সমর্থক ও বিরোধীরা আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছিল। তবে সেখানে একটি ভিন্ন চিত্রও দেখা যায়—অনেকেই ডিম হাতে অপেক্ষা করছিলেন, যা প্রতীকীভাবে ফজলে করিমের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। এ অবস্থায়, নিরাপত্তাজনিত কারণে সেদিন পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করতে পারেনি।

এই ঘটনার পর চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষ ফজলে করিম চৌধুরীর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। তার দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী অবস্থান এবং তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রেক্ষিতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে আরও মামলাগুলো কীভাবে প্রক্রিয়াকরণ হয়, সেটাই হবে তার ভবিষ্যতের নির্ধারক।

আখাউড়া সীমান্তে তার আটক হওয়ার ঘটনাটি তার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় ধাক্কা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য থেকে অবৈধভাবে দেশ ত্যাগের চেষ্টায় ধরা পড়া—এ ঘটনা তার রাজনৈতিক জীবনকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং জনমনে সৃষ্ট বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, ফজলে করিমের বিরুদ্ধে মামলাগুলো কিভাবে পরিচালিত হবে এবং আইনি প্রক্রিয়া কিভাবে অগ্রসর হবে, সেটিই এখন সবার চোখের সামনে রয়েছে।

ফজলে করিমের অপরাধ জগতের বিচরণ

১৯৮৯ সালে ছাত্রলীগ নেতা বাবর মুজিব হত্যার মাধ্যমে ফজলে করিমের হত্যার রাজনীতির সূচনা ঘটে। সেই অপরাধ জগতের ডন থেকে তিনি হয়ে উঠেন রাজনৈতিক সাম্রাজ্যের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার উত্থান-পতনের পথে রয়েছে অসংখ্য অজানা অধ্যায়, যা আজও জনসমক্ষে আসে না। আমি বহুবার তার অপরাধ নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি, এবং এই লেখায় তার অপরাধের কিছু দিক তুলে ধরার প্রয়াস করেছি। রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর অপরাধ সাম্রাজ্যের প্রকৃত বিস্তার ঘটে ২০০৮ সালের পর। খুন, জমি দখল, এবং গুম—এগুলো ছিলো তার অপরাধ কর্মকাণ্ডের নিয়মিত অংশ। শুধুমাত্র নিজেই নয়, তার অনুসারীরাও বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে তার প্রভাব ও ক্ষমতার বদৌলতে। পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ—সর্বত্র বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করানো ছিলো তার অন্যতম রাজনৈতিক কৌশল। উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মেম্বার পর্যন্ত, সবখানেই ফজলে করিম তৈরি করেছিলেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা ছিল তার ক্ষমতার প্রতিফলন।

মতের অমিল বা বিরোধিতার কারণে ২০১০ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকা থেকে ফজলে করিমের অনুসারী আবু জাফরকে তুলে নিয়ে গুম করা হয়। বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আবু জাফরের মতো আরও অনেকে এই একই ভাগ্য বরণ করেছেন।রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে, স্থানীয় পুলিশও তার ভয়ে তটস্থ থাকত। বিএনপি কর্মী মুছা প্রায় সতের বছর ধরে রাউজান ছেড়ে দূরে ছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ওমান থেকে ফিরে পিতার কবর জিয়ারত করতে রাউজানে এসে তিনি খুন হন। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাই ছিলেন ফজলে করিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অভিযোগ রয়েছে, ফজলে করিম চৌধুরী প্রভাব খাটিয়ে মুছার মৃত্যু হৃদরোগে হয়েছে বলে সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করান, যাতে হত্যা মামলার আলামত গোপন করা যায়।

২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে ফজলে করিমের প্রত্যক্ষ মদদে পুলিশ কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুকে আটক করে হত্যা করে এবং তার লাশ কর্ণফুলী নদীর তীরে ফেলে রাখা হয়। তার স্ত্রী সুমি আক্তার এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য দীর্ঘ সাত বছর অপেক্ষা করতে বাধ্য হন। অবশেষে সম্প্রতি চট্টগ্রামের চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তিনি, যেখানে ফজলে করিম চৌধুরীসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় ৩০-৪০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ফজলে করিমের বিরোধীরা কারও আত্মীয়স্বজন মারা গেলে তাদের জানাজায় অংশ নিতে পারতেন না। এমনকি রাউজানের ছাত্রলীগ নেতা মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনের মায়ের জানাজায় ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে ফজলে করিম বাধা দেন। গহিরায় অনুষ্ঠিত এই জানাজায় রোটনের বাড়ির পাশে থাকা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার, মারধর এবং অপমান করা হয়। এছাড়াও, মায়ের কুলখানিতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে মেজবানের রান্না বন্ধ করারও অভিযোগ আছে। রান্নার বাবুর্চিদের উপর নির্যাতন এবং নানা ধরনের অপকর্ম করা হয়।

এই বিষয়ে কথা বলার জন্য মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ফজলে করিমের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি পূর্ব রাউজানে শেখ রাসেলের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালের ১ এপ্রিল শেখ রাসেল পৌর জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারত। তবে কিছুদিন পরই এটি অচল হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে ওই বিদ্যালয়ের কাছাকাছি ‘এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আওয়ামী লীগ নেতা মন্তব্য করেন, “শেখ রাসেলের নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুল রাউজানের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হতে পারত, কিন্তু এমপি ফজলে করিম নিজের নামে বিদ্যালয় করে শেখ পরিবারের প্রতি তার আসল মনোভাব উন্মোচন করেছেন। যদিও ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেনি, কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রেমিরা তার এই কর্মকাণ্ডকে অন্তরে ঘৃণা করেছে।”

এছাড়াও, ফজলে করিমের বিরুদ্ধে আরও একটি গুরুতর অভিযোগ হলো, রাউজানের সব ইটভাটা থেকে প্রতি বছর ২ লক্ষ টাকা করে তাকে দিতে হতো। সেই সঙ্গে উপজেলার সকল সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারকৃত কাজের জন্য ঠিকাদারদের কাছ থেকে তিনি ২০ শতাংশ কমিশন নিতেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য।

অভিযোগের বিশদ বিবরণ: সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর দুর্নীতির করাল গ্রাস

জানা যায়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এবং চট্টগ্রাম তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (রাউজান) বিভিন্ন কাজের ঠিকাদারদের কাছ থেকে পাহাড়তলী ইউপি চেয়ারম্যান রোকন উদ্দিনসহ অন্যান্য মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ সংগ্রহ করতেন সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। সরেজমিনে তদন্তের মাধ্যমে বহু মানুষ এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অমানবিক চিত্র

সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরী ষোল বছর ধরে রাউজানের সংখ্যালঘুদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছেন। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেনি। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বহু মানুষ সাহসী হয়ে এসব নির্যাতনের কথা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। সংখ্যালঘুদের জায়গা দখল, অত্যাচার, এবং হত্যা—এসবই ছিল তার রাজত্বের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

 

বিভিন্ন মামলার তথ্য ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশিষ্ট আইন বিশারদ এডভোকেট নলিনী রক্ষিতের নোয়াপাড়া গ্রামের ১৫ একর মূল্যবান ভূমি দখল করার পেছনে তার নাম জড়িত। এমনকি তার দৌহিত্র শ্রীকান্ত রক্ষিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী ছিলেন প্রধান অভিযুক্ত। মামলার বিবরণ অনুযায়ী, শ্রীকান্তের লাশ হাটহাজারীতে এবং তার খণ্ডিত মাথা মিরসরাইতে পাওয়া যায়। প্রভাব খাটিয়ে তিনি মামলাটি থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। তবে এসবের পরও সংখ্যালঘুদের ওপর তার অত্যাচার বন্ধ হয়নি। জমিদারদের সম্পত্তি দখল ও নাম পরিবর্তনের অপকৌশল এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বাস বাড়ির জমি দখল করে তার মা-বাবার নামে কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। নোয়াপাড়ার জমিদার মোক্ষদা রঞ্জনের নিজস্ব ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মোক্ষদা রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় করা হয়। এমনকি সেখানে নির্মিত সড়কে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধী লাল মিয়া টেন্ডলের নামে তোরণ স্থাপন করা হয়। রাউজানের হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল্যবান জমি জোরপূর্বক দখল করে বাড়িঘর, মসজিদ এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এসব জায়গা দখলের জন্য বহু সংখ্যালঘুকে চরমভাবে অত্যাচার করা হয়েছে।

একনায়কতন্ত্রের উত্থান ফজলে করিম চৌধুরী রাউজান উপজেলাজুড়ে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। তার ক্ষমতার সামনে শুধুমাত্র বিএনপি বা জামায়াতই নয়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ছিলেন অসহায়। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হতো না। এছাড়া আওয়ামী লীগের বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপরও তিনি নির্যাতন চালিয়েছেন।

স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্বাচনে ফজলে করিমের সমর্থিত প্রার্থীরাই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করত। টাকা ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী নির্বাচন করতে সাহস করত না।

ভূমি দখল ও বিক্রির চক্র এমপির নির্দেশে নোয়াপাড়ায় সরকারি জায়গা এবং ভট্টাচার্য পরিবারের পৈতৃক জমি জোরপূর্বক দখল করা হয়। পরবর্তীতে এসব জমি এমপি উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দেন। নোয়াপাড়ায় বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছয় একর জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রাখা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকদাইর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী জমিদার ভবিৎ সওদাগরের মন্দিরসহ প্রায় ৩৯ একর জমি দখল করা হয়েছে। এছাড়া, রাউজানের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী রামমোহনের দিঘীও এমপি ফজলে করিমের অবৈধ দখলে রয়েছে। পাহাড়তলী ইউনিয়নের উনসত্তর পাড়ায় লিটন দাশের পৈতৃক ভূমি বিক্রির সময় ভূমির মূল্য বাবদ নগদ ১ কোটি টাকা এমপি ফজলে করিমকে প্রদান করতে হয়েছে।

 

শ্রীশ্রী জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু গৌরাঙ্গ দে’র নোয়াপাড়াস্থ গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি এমপির নামে লিখে দেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি প্রদান করা হয়েছিল। এই বাড়িতে ঘরবাড়ি ছাড়াও একটি প্রতিষ্ঠিত মন্দির এবং পূর্বপুরুষদের শ্মশান রয়েছে। রাউজান, যেখানে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেনসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মস্থান, সেখানে সরকারের ডাক বাংলোটি স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতাকারী এমপির পিতা মরহুম ফজলুর কবির চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। ফজলে করিমের বিরুদ্ধে মামলা:বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই গা ঢাকা দেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, যার মধ্যে রাউজানের সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিমও রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে মানুষের প্রতিবাদের মুখে মামলা দায়ের শুরু হলে কিছুটা আশা দেখা দেয় রাউজানবাসীর মনে। এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত রাউজান থানা এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে ৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

আদালত ও থানা সূত্রে জানা যায়, ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতে গুম করে হত্যার চেষ্টা, চাঁদাবাজী ও লুটপাটের মামলা করেন পশ্চিম গুজারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজউদ্দিন দৌলা। এই মামলায় এবিএম ফজলে করিমসহ ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ২৩ আগস্ট রাউজান থানায় বাদী হয়ে হত্যা, ভাঙচুর, লুটপাট ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মামলা করেন মুনিরিয়া যুব তবলীগ কমিটির ১০৩ নম্বর দলইনগর-নোয়াজিষপুর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন। ফজলে করিম ও ফারাজ করিমসহ ৪৩ জনকে আসামি করে ওই মামলা দায়ের করা হয়, যেখানে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২০-২৫ জনকে।

২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন ইসতিয়াক হোসেন, যেখানে ফজলে করিমসহ ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে, ২৫ আগস্ট রাউজান থানায় বাদী হয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মামলায় ফজলে করিম ও ফারাজ করিমসহ ৪৬ জনকে আসামি করা হয়েছে, এবং সেখানে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২০-৩০ জনকে।

এছাড়া, ২৭ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতে রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন, যেখানে ফজলে করিমকে ১৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে। ২৫৩ জনকে আসামি করে ওই মামলা দায়ের করা হয় এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১০০-১৫০ জনকে। ২৮ আগস্ট পাঁচলাইশ থানায় বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন লালখানা বাজার এলাকার মো. দুলাল, যেখানে ফজলে করিমসহ ২৬৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। ৩০ আগস্ট চান্দগাঁও থানায় বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন বহদ্দারহাট এলাকার মো. শরীফ, যেখানে ফজলে করিম ও ফারাজ করিমসহ ৪৪ জনকে আসামি

বিতর্ক এবং প্রভাব

ফজলে করিমের বিরুদ্ধে এতোগুলো মামলার ফলে রাউজানবাসীর মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা এবং বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে ক্ষমতার প্রভাব ও অর্থবিত্তের বলয়ে রাউজানকে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে সাধারণ জনগণ এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেছে। এমপি ফজলে করিমের উপর দায়েরকৃত এসব মামলা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের ফল নয়, বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি প্রতিফলন। ক্ষমতার অপব্যবহার, জবরদস্তি করে সম্পত্তি দখল, এবং জনগণের অধিকার হরণের অভিযোগগুলো সত্য প্রমাণিত হলে তা শুধু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পতন নয়, বরং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের প্রতীক হতে পারে।

তবে, এসব মামলার বিচার প্রক্রিয়া এবং ফলাফল কোন পথে অগ্রসর হবে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। জনগণের পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী আন্দোলন ও সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে যাতে সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়, জনগণের চেতনা ও প্রতিরোধই এই অপশাসনের অবসান ঘটাতে পারে।

লেখক সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান- দৈনিক ভোরের আওয়াজ এবং The Daily banner –

 

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
© সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট