হিংসা প্রতিটি মানুষের জীবনের এক অভিশাপ, যা আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক আচরণ দেশের অগ্রগতি ও সংহতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ আমাদের সামনে সেই বাস্তবতা স্পষ্ট—যে রাজনৈতিক সংগঠন হিংসা ও প্রতিহিংসার নীতি অনুসরণ করে, তাদের শাসন কতটা বিধ্বংসী হতে পারে তা এখন আর কোনো লুকোচুরির বিষয় নয়। বিশেষ করে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রতিহিংসার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা নতুনভাবে শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে আমরা বারবার দেখেছি প্রতিহিংসার রাজনীতির করাল গ্রাস। বিরোধী দল ও মতকে দমিয়ে রাখতে, গণতন্ত্রের মূলে আঘাত হানতে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রতিহিংসার হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়েছে। আজ যারা ক্ষমতায় আছে বা আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা কি শেখ হাসিনার মতোই প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে? এই প্রশ্নটি আজ খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ, প্রতিহিংসার রাজনীতি কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে, তার প্রমাণ শেখ হাসিনা আমাদের দিয়ে গেছেন।
প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি শুধু দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নয়, গোটা জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আজ দেশের যে অবস্থা, তার প্রধান কারণই হচ্ছে এই প্রতিহিংসার রাজনীতি। ক্ষমতার জন্য একে অপরকে আঘাত করার প্রবণতা আমাদের সামাজিক বন্ধনকেও নষ্ট করে দিচ্ছে। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিবর্তে, ক্ষমতাসীনরা প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে চায়, যা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে একেবারেই সাংঘর্ষিক।
প্রতিহিংসার রাজনীতি নিয়ে আমার কিছু কথা তুলে ধরছি—এই রাজনীতি আমাদের সমাজকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। জাতীয় সংহতি ও গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে প্রতিহিংসার রাজনীতি বর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। যারা নতুনভাবে ক্ষমতায় আসবেন, তাদের কাছে জাতির একটাই প্রত্যাশা—প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে মুক্তি দিয়ে সত্যিকার অর্থে জনগণের কল্যাণে নিবেদিত একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।চলুন প্রতিহিংসার রাজনীতি নিয়ে কিছু আলোকপাত করে আসি-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ছিলেন এক উচ্চশিক্ষিত, অভিজ্ঞ, যদিও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি বহু রচনা লিখেছেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘এ হিস্ট্রি অব দ্য ইংলিশ স্পিকিং পিপলস’, একটি চার খণ্ডের গ্রন্থ। গ্রন্থটির সূচনায় চার্চিল চারটি মূল্যবান আপ্তবাক্য উল্লেখ করেছেন: ০১. ‘ইন ওয়ার রেজলিউশন’ ০২. ‘ইন ভিক্টরি ম্যাগনেনিমিটি’ ০৩. ‘ইন ডিফিট ডিফাইয়েন্স’ এবং ০৪. ‘ইন পিস গুড উইল’। এই বাক্যগুলো যুদ্ধ এবং শান্তিকালের আচরণ ও মানসিকতার প্রতিফলন। যুদ্ধের সময় রেজলিউশন বা সংকল্প থাকা জরুরি, এবং বিজয়ের পর মহানুভবতা—এটি চার্চিলের মতে আদর্শ। কিন্তু বাস্তবিকভাবে অনেক সময় বিজয়ী জাতিরা এ আদর্শকে মানতে পারে না। এ কারণেই ইতিহাস বিজয়ীদের কলমে লেখা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যদি জার্মানি বিজয়ী হতো, ইতিহাস হয়তো ভিন্নভাবে লেখা হতো। ঠিক একইভাবে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যদি বাংলাদেশ পরাজিত হতো, আমাদের মুখে আজকের মতো বিজয়ের গল্প হয়তো বলা যেত না।
চার্চিলের ‘ইন ভিক্টরি ম্যাগনেনিমিটি’ বা বিজয়ের পর মহানুভবতা আমরা স্বাধীনতার পরে পালন করতে পারতাম, কিন্তু তা হয়নি। আমাদের প্রিয় নবী করিম (সা.) মক্কা বিজয়ের পর সমস্ত শত্রুদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাঁর এই মহানুভবতা মানবতার এক অনন্য উদাহরণ। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের পর একই ধরনের মহানুভবতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি, কারণ আমাদের বিজয় এককভাবে অর্জিত হয়নি; সাথে ছিল ভারত, যারা মুসলিমদের প্রতি বৈরী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে বিজয়ীদের আচরণে ‘ইন ভিক্টরি ম্যাগনেনিমিটি’ ধারণাটি অবজ্ঞা করা হয়েছে। বিজয়ের পরপরই হিংসা ও প্রতিশোধের আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল, যা এখনো বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে রয়েছে। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মুক্তিযুদ্ধের সেই জ্বলন্ত সময়ের সঠিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রতিটি দেশপ্রেমিক হৃদয়কে উৎকণ্ঠিত করে তুলেছিল। এক অজ্ঞাত যুবকেরা স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল, কিন্তু যুদ্ধ শেষে তারা মূলধারায় স্থান পায়নি।” মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং ফিরে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর যুদ্ধের সময় যারা এদেশে থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছিল, তাদের অনেককেই পরবর্তী সময়ে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই অবিচার ও বৈষম্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। আজকের বাংলাদেশে ইতিহাসে এদের যথাযথ স্বীকৃতি না দিয়ে বরং তাদের হেয় করা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় প্রভাব এবং পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণার ছায়া এখনো বিদ্যমান। আওয়ামী লীগ ও এর সমমনা দলগুলো সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়ে দেয় এবং ভারতের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রমাণ করতে ব্যস্ত। তবে ভারতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার এই নীতি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে বড় ক্ষতি করছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতায় থাকা একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লড়াই এখন দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক অসম প্রতিযোগিতার রূপ নিয়েছে। এই লড়াইয়ের মধ্যে জনগণের কোনো ভূমিকা নেই, তাদের ম্যান্ডেটকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণকে প্রান্তিক করে ফেলা হয়েছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা হারিয়েছে। বিজয়ীর মহানুভবতা, পরাজিতের দৃঢ়তা, এবং শান্তির শুভেচ্ছা—এ তিনটি গুণ আমাদের জাতীয় চেতনার মূলে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক অবিরাম সংঘাত চলছে। চার্চিলের ভাষায়, ‘ইন ওয়ার রেজলিউশন’ এবং ‘ইন ডিফিট ডিফাইয়েন্স’ রয়েছে, কিন্তু ‘ইন পিস গুড উইল’ অনুপস্থিত। দেশ এখন এক অস্থিতিশীল রাজনৈতিক বাস্তবতায় আবদ্ধ, যেখানে শান্তি এবং সংহতি কেবলই দূরবর্তী স্বপ্ন।
আপনার লেখাটি আরও সংযুক্ত করে সমৃদ্ধ করতে কিছু বিষয় যুক্ত করা যেতে পারে, যেমন:
১. বিজয়ের পরবর্তী রাজনৈতিক সংঘাত ও ইতিহাস বিকৃতি
বিজয়ের পরপরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে বিভক্তি ও সংকট শুরু হয়, তা আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিভিন্ন সময় বিকৃত করা হয়েছে, যেখানে যুদ্ধের প্রকৃত বীরদের অবমূল্যায়ন এবং পলাতক নেতাদের মহানায়কের আসনে বসানো হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘ইন ভিক্টরি ম্যাগনেনিমিটি’ ধারণাটি পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়। এ ইতিহাসের বিকৃতি কেবল জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে, এবং আজকের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যানার ব্যবহার করছে। ২. ভারতীয় প্রভাব ও জাতীয় স্বার্থের অবমাননা মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একটি বড় ভূমিকা পালন করে এসেছে। দেশের স্বার্থের পরিবর্তে ভারতীয় প্রভাব ও স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলোর মধ্যে। ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখা এবং প্রতিপক্ষকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ আখ্যা দেওয়া একটি সাধারণ রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ ধরনের নীতি কেবল দেশের ভেতরে বিভাজন সৃষ্টি করেছে, এবং জাতীয় সংহতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
৩. রাজনৈতিক বৈরিতা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান লড়াই কেবল ক্ষমতা দখলের জন্যই নয়, এর প্রভাব দেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াতেও পড়েছে। উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলো আজ তাদের পার্টি-নির্ভর হয়ে গেছে, এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা হারিয়েছে। এর ফলে সঠিক নীতিমালা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকর করতে বারবার ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যে ‘ডিফাইয়েন্স’ বা একে অপরের প্রতি বৈরিতা রয়েছে, তা জনগণের কল্যাণের বদলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার উপর বেশি কেন্দ্রীভূত। ৪. শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা ও জাতীয় ঐক্যের অভাব ‘ইন পিস গুড উইল’—এই ধারণাটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতার জন্য এই অশান্তি এবং দ্বন্দ্ব কেবল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে তুলেছে। আজ দেশের অধিকাংশ জনগণ এ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হতাশ এবং ভবিষ্যতের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা আজ এক দুরূহ লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৫. সামরিক বাহিনীর ভূমিকায় স্বাধীনতার বিকাশ
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় উঠে আসে। এরপর থেকে সামরিক শাসন ও অস্থায়ী সরকার গুলো দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সামরিক শাসনের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে এর বিপরীতে, কিছু মানুষ মনে করে সামরিক শাসন এক ধরণের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছিল, যদিও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে তা ছিল প্রতিকূল।
৬. ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও
আত্মত্যাগের ইতিহাস আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন ও ইতিহাস বিকৃতির কারণে তরুণ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধ ও চেতনা তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে না পারলে, জাতীয় ঐক্য ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া ভবিষ্যতেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ইতিহাসের সঠিক পাঠ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বীরদের সম্মান দেওয়াই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর মহানুভবতা, জাতীয় ঐক্য, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে, তা আজো আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। আমাদের জাতীয় চেতনার মূলে থাকা উচিত সত্য, ঐক্য, এবং শান্তির প্রক্রিয়া, কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা বিভাজন এবং শত্রুতা বেছে নিয়েছি। চার্চিলের আপ্তবাক্যের আলোকে, আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সত্যিকারের মূল্যায়ন করি, তাহলে দেশের অভ্যন্তরে শান্তি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান দৈনিক ভোরের আওয়াজ এবং The Daily banner