সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি সত্য ও ন্যায়ের সন্ধানে এক অসীম যাত্রা। মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার ভূমিকা অপরিসীম। তথ্যের আলোকে সমাজকে আলোকিত করা, অন্যায়ের মুখোশ উন্মোচন করা, এবং সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করা—এগুলি সাংবাদিকতার প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাস, বর্তমান অবস্থান, এবং পেশাদারিত্বের চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের দেশের গণমাধ্যমের পরিবেশকে নতুনভাবে বুঝতে সাহায্য করে। তবে সময়ের সাথে সাথে সাংবাদিকতা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনই তৈরি হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকরা যেমন স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার লড়াই করছেন, তেমনই বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আজ একদিকে লেখার স্বাধীনতার সংকট এবং নিরাপত্তার অভাবের মুখোমুখি। পাশাপাশি কিছু অংশ সরকারের তোষামোদ এবং চাঁদাবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত। এই জটিল বাস্তবতায়, পেশাদার সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানই হতে পারে আমাদের আগামীর লক্ষ্য।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা: বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মান বিভিন্ন দিক থেকে উন্নতির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সংবাদমাধ্যমে তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, এবং সার্বিক পেশাদারিত্ব সব দিক থেকেই দেশটি একটি প্রশ্নবোধক অবস্থানে রয়েছে। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হলো:
১. লেখার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা:
লেখার স্বাধীনতা:
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করেছে। তবুও, বাস্তবে সাংবাদিকদের লেখার স্বাধীনতা সীমিত। বিশেষ করে সরকারের সমালোচনা করলে বা বিতর্কিত সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সেন্সরশিপ, হুমকি, এমনকি মামলার সম্মুখীন হতে হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ সাল থেকে ব্যাপকভাবে সাংবাদিকদের ওপর চাপ বাড়িয়ে তুলেছে, যেখানে সামান্য সমালোচনামূলক লেখা বা মন্তব্যের জন্যও সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে।নিরাপত্তা:
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বাংলাদেশে একটি গুরুতর সমস্যা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করলে সাংবাদিকরা হুমকি, নির্যাতন, এবং শারীরিক আক্রমণের শিকার হন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরগুলোতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার অভাব প্রকট। ২০২২ সালে সাংবাদিকদের ওপর হামলার বেশ কয়েকটি ঘটনা এই বিষয়ের জটিলতা আরও প্রকট করেছে।
২. সাংবাদিকদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ,
সরকারের তোষামোদ ও দালালি: বাংলাদেশে সাংবাদিকদের একটি অংশ সরকারের তোষামোদে জড়িয়ে পড়েছে, যাকে রাজনৈতিক আনুগত্য বা চাঁদাবাজি হিসেবে দেখা হয়। এর প্রধান কারণ: আর্থিক অনিশ্চয়তা: অনেক সাংবাদিক আর্থিকভাবে দুর্বল অবস্থায় থাকেন, এবং সংবাদমাধ্যমের মালিকপক্ষ প্রায়ই রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে জড়িত থাকেন।
স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্বের অভাব: সাংবাদিকরা অনেক সময় রাজনৈতিক চাপে কাজ করতে বাধ্য হন, যার ফলে তাদের পেশাদারিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চাঁদাবাজি ও অনৈতিকতা: কিছু সাংবাদিক রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য নিজেদের অবস্থানকে অপব্যবহার করেন।
সমাধান: অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা: সাংবাদিকদের জন্য সম্মানজনক আর্থিক প্রণোদনা এবং যথাযথ বেতন কাঠামো তৈরি করা উচিত, যাতে তারা চাপমুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারেন।
পেশাগত নৈতিকতা: সাংবাদিকদের জন্য নৈতিকতা, সততা, এবং দায়িত্বশীলতার মানদণ্ড প্রণয়ন ও অনুসরণ করা প্রয়োজন। আইনের সুরক্ষা:সাংবাদিকদের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করা উচিত, যা সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেবে।
৩. ভালো সাংবাদিক হতে হলে কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে:
পেশাগত যোগ্যতা:
গভীর পর্যবেক্ষণ: একজন ভালো সাংবাদিককে অবশ্যই সমাজের চলমান বাস্তবতা, রাজনৈতিক ঘটনা, এবং আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
গবেষণা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা: তথ্য সংগ্রহ এবং তা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা একজন ভালো সাংবাদিকের মূল দক্ষতা। তথ্যের সত্যতা যাচাই করা, এবং তথ্যবহুল, প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদন তৈরির জন্য গবেষণার উপর জোর দিতে হবে।
নিরপেক্ষতা: সাংবাদিকদের সবসময় নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে হবে। পক্ষপাতিত্ব বা ব্যক্তিগত স্বার্থবুদ্ধি জড়িয়ে সাংবাদিকতা করলে তা পেশার জন্য ক্ষতিকারক।
যোগাযোগ দক্ষতা: একটি প্রতিবেদন সহজ ও বোধগম্য ভাষায় প্রকাশ করতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সোর্সদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে তোলাও একধরনের যোগ্যতা।
শিক্ষাগত যোগ্যতা:
সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সাংবাদিকদের জন্য মৌলিক ধারণা, নৈতিক দায়িত্ব এবং গবেষণা পদ্ধতির উপর দক্ষতা দেয়। যদিও অনেক প্রতিভাবান লেখক বা সম্পাদক উচ্চশিক্ষা ছাড়াই সাংবাদিকতা করছেন, তবে সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দেয়। এর কারণ:
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও আধুনিক প্রযুক্তির জ্ঞান: সাংবাদিকতার উচ্চশিক্ষা আধুনিক রিপোর্টিং প্রযুক্তি, ডিজিটাল মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোর কাজকর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দেয়।
সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও আইন: উচ্চশিক্ষায় সাংবাদিকতার বিভিন্ন নৈতিক দিক এবং সংবাদ প্রচারের সুরক্ষা ও আইন সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া যায়।
৪. অনলাইন সাংবাদিকতা ও এর গ্রহণযোগ্যতা:
বর্তমান সময়ে অনলাইন সাংবাদিকতা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বাংলাদেশেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো সংবাদ প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিছু সংস্থা এখনও অনলাইন সাংবাদিকতাকে সাংবাদিকতা হিসেবে মানতে চায় না, তবে বর্তমান বাস্তবতায় এটি গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনলাইন সাংবাদিকতার বিশেষ গুরুত্ব:
তাৎক্ষণিকতা ও গতি: অনলাইন সংবাদ তাৎক্ষণিক ভাবে পরিবেশিত হয়, যা প্রিন্ট মিডিয়ার তুলনায় দ্রুতগতির।
পাঠকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ: অনলাইন সাংবাদিকতা পাঠকদের সাথে দ্রুত এবং সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ দেয়, যা আধুনিক যুগের সংবাদ পরিবেশনায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৫. প্রেসক্লাব ভিত্তিক সাংবাদিকতা:
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা প্রায়শই প্রেসক্লাবের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক সাংবাদিক প্রেসক্লাবের সদস্য, এবং সেখানে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সামাজিক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। প্রেসক্লাব ভিত্তিক সাংবাদিকতা
রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব: অনেক ক্ষেত্রে প্রেসক্লাব রাজনৈতিক দলের পক্ষাবলম্বন বা সহযোগিতা করে, যা পেশাগত স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
মাধ্যমিক সম্পর্কের গুরুত্ব: সাংবাদিকরা প্রায়শই রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, যা সাংবাদিকতার পেশাগত মানদণ্ডে আঘাত করে।
উন্নয়নের পথ:
প্রেসক্লাবকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষ রাখা: প্রেসক্লাবগুলোর উচিত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য কাজ করা। সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে ট্রেনিং: সাংবাদিকদের জন্য নিয়মিত ট্রেনিং ও দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা পেশাগত মানোন্নয়নে উৎসাহী হতে পারেন।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা একটি শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও, কিছু গুরুতর সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, এবং পেশাদারিত্বের অভাব সাংবাদিকদের কাজকে কঠিন করে তুলছে। তবে, আর্থিক সুরক্ষা, নৈতিকতা বজায় রাখা, এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করলে সাংবাদিকতা আরও উন্নত ও কার্যকর হতে পারে। দক্ষ লেখক বা সাংবাদিক হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে শুধু শিক্ষার সার্টিফিকেট নয়, প্রকৃত যোগ্যতা, নৈতিকতা, এবং তথ্যপূর্ণ লেখার দক্ষতাই একজন ভালো সাংবাদিক তৈরি করতে পারে।
চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের সংকট: দালালির বেড়াজাল আর পেশাদারিত্বের সংকট
আমাদের চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা একটি চরম সংকটে আছে। সবচেয়ে দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক বিষয় হলো, একজন সাংবাদিক অন্য আরেকজন সাংবাদিককে সম্মান না করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, এবং নানানভাবে অপমানজনক আচরণ করছে। বিশেষত, কিছু সাংবাদিক যারা লেখালেখির চেয়ে দালালি আর চাঁদাবাজিতেই বেশি আগ্রহী, তারা নিজেদের একমাত্র বিখ্যাত সাংবাদিক হিসেবে উপস্থাপন করে। অথচ, তাদের কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা বিশ্ববরেণ্য নন, বরং বেইশ্যাবরণ্য, বিখ্যাত নন, কুখ্যাত সাংবাদিক।
এই ধরনের সাংবাদিকরা প্রায়ই প্রেসক্লাব সিন্ডিকেটের নেতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বকে ছাপিয়ে দালালি করে যতটা নাম কামিয়েছে, সেই তুলনায় প্রকৃত সাংবাদিকতা বা লেখালেখিতে তেমন কোনো অবদান রাখেনি। তারা অনলাইন সাংবাদিকতাকে তো সাংবাদিকতা হিসেবেই মানতে চায় না, যদিও অনলাইন সাংবাদিকতা আজকের পৃথিবীতে অনেক এগিয়ে। তারা সরকারি অফিসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিজেদের সিন্ডিকেটের সাংবাদিকদের ভুয়া সাংবাদিক হিসেবে উপস্থাপন করে, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনে। অথচ যাদেরকে ভুয়া সাংবাদিক বলা হচ্ছে, তারা তাদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ এবং তাদেরকে সাংবাদিকতার ক্লাস করাতে সক্ষম।
বিশেষত টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের আচরণ সবচেয়ে খারাপ। তারা সাধারণত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও ফুটেজ নিয়ে সামান্য কিছু কথা জুড়ে দেয় এবং সেটাকেই নিউজ বলে প্রচার করে। অথচ তাদের নিজস্ব কোনো মতামত বা শব্দ থাকে না, তথ্য তো দূরের কথা। আর এই তথাকথিত সাংবাদিকরাই প্রকৃত লেখক বা সাংবাদিকদের ভুয়া বলে অপমানিত করে। তাদের মুখে থুথু ছুড়তে ইচ্ছে হয়।
এখন সময় এসেছে দালালি ও চাঁদাবাজ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কলম ধরার। বিশেষত, যেসব প্রতিষ্ঠান এই ধরনের সাংবাদিকদের প্রাধান্য দেয়, তাদের বিরুদ্ধেও কথা বলার সময় এসেছে। আসল কে, নকল কে—তা সবার সামনে স্পষ্ট করতে হবে।
আজ থেকে আমি সারা বিশ্বের সাংবাদিকতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, এবং তাদের সুরক্ষার নানা সুযোগ সুবিধা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেছি। প্রতিদিন চোখ রাখুন।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব,চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।