চট্টগ্রামে ভেট নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়া এবং আব্দুল্লাহ আল নোমানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ আজও তাদের নামে বা তাদের স্মৃতি স্মরণে কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, “আপনি এখন কেন বলছেন? আগেতো বলেননি?” তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আমি নিজেই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলাম। বহু বছর ধরে আমি চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আজকের এই লেখাটি উপস্থাপন করছি।১৯৯৫ সালে যখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন জনাব আব্দুল্লাহ আল নোমান পশুসম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমার নেতা এস. এম. জামাল উদ্দিনের কারণে নোমান ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির সভাপতি এবং মূল সংগ্রাম কমিটির ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে রাজপথে আন্দোলনে ভূমিকা পালন করতাম।
একদিন সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের কর্ণফুলী হলে নোমান ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাই। দেখা মাত্রই তিনি বললেন, “কামাল, আমি তোমাকে খুঁজতেছি!” কথাটি তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় বলেছিলেন, যা আমাকে চিন্তিত করে তোলে। তারপর তিনি রুমের সবাইকে বের করে দিয়ে বললেন, “তুমি যে কাজে আসছো, আমি পরে করেদেব। তুমি এখন জামাল ভাইয়ের সাথে দেখা করে তাকে বলো আমাকে একটা ফোন করতে।”
আমি জামাল ভাইয়ের ফোন নম্বরআ (৬১১৯৪০)টি দিয়েছিলাম । নোমান ভাই তখন বলেন, “শোনো, বাংলাদেশের দুটি ভেট নারী কলেজ হবে—একটি ময়মনসিংহে এবং অন্যটি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। আমি চাই শাহজাদপুরের পরিবর্তে চট্টগ্রামে একটি কলেজ হোক। কিন্তু আমি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাইরে কিছু বলতে পারি না। তাই জামাল ভাইকে বলো যেন চট্টগ্রামে ভেট নারী কলেজের প্রয়োজন উল্লেখ করে একটি কর্মসূচি দেয়। তোমরা এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করো, যাতে আমি বলতে পারি যে চট্টগ্রামের মানুষ ভেট নারী কলেজ চাচ্ছে।”আমি এস. এম. জামাল উদ্দিন ভাইয়ের সাথে দেখা করে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির নামে পত্রিকায় বিবৃতি দিই। তারপর মাসিক মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করি। মূল সংগ্রাম কমিটি এবং ছাত্র সংগ্রাম কমিটির যৌথ উদ্যোগে আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেই কর্মসূচি পালন করি।আমরা পূর্বকোণ পত্রিকার চেয়ারম্যান ইউসুফ চৌধুরীর সাথে দেখা করি। তিনি তখন চট্টগ্রাম ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন এবং তার সংগঠন থেকে কর্মসূচি নিয়ে পূর্বকোণ পত্রিকায় বড় বড় করে খবর প্রকাশ করেন। তার সাথে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাইদুল আলম কাদেরী, যিনি পরে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি আমাদের সংগ্রাম কমিটির মহাসচিব ছিলেন। ইউসুফ চৌধুরী এবং সাইদুল আলম কাদেরী প্রথম একটি রোগা গরু নিয়ে মিছিল করেছিলেন, যা থেকে আন্দোলন শুরু হয়। আমরা আলাদা আলাদাভাবে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাই এবং কলেজ বাস্তবায়ন পর্যন্ত সেই আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং তখন আর তেমন কিছু করার প্রয়োজন হয়নি। পরবর্তীতে, ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে। তখন নোমান ভাইয়ের পরামর্শে আমরা পুনরায় ভেট নারী কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের জন্য আন্দোলন শুরু করি। এসময় ইউসুফ চৌধুরী ও দৈনিক পূর্বকোণের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের উদ্যোগেই কলেজটি ভেট নারী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল চট্টগ্রামের উন্নয়নের অগ্রদূত মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমানের। তিনি তার মেধা ও ধৈর্য দিয়ে যেভাবে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরও করিয়েছিলেন। আজ এটি একটি অজানা ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। অথচ আজও বিশ্ববিদ্যালয়ে বেগম খালেদা জিয়া, আব্দুল্লাহ আল নোমান, কিংবা এস. এম. জামাল উদ্দিনের নামে কোনো স্মৃতিসৌধ বা স্থাপনা নেই। তাদের অবদানকে এভাবে অস্বীকার করার মানে হয় না। আজ সময় এসেছে তাদের অবদানের কথা স্মরণ করে রাখার জন্য কোনো না কোনো স্থাপনা নির্মাণের। আমাদের উচিত সরকারি ইতিহাস দেখে বোঝা, ভেট নারী কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া কিভাবে হয়েছিল এবং কীভাবে এই প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়া ও আব্দুল্লাহ আল নোমানের অবদান রয়েছে।১৯৯৫-১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার সিলেট ও চট্টগ্রামে দুটি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে, দিনাজপুর ও বরিশালে আরও দুটি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি কলেজটির প্রাথমিক নাম ছিল “চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ,” যা সংক্ষেপে “চসভেক” নামে পরিচিত ছিল। এটি ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজটির বড় সিলেবাস এবং পড়াশোনার ব্যাপকতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতি নিয়ে চসভেককে একটি আলাদা অনুষদে রূপান্তরিত করে। তবে, তখন পুরো চট্টগ্রামে কোনো কৃষি বা ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ফলে, চট্টগ্রামের মানুষ এবং বিশেষত চট্টগ্রামের সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে চসভেককে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের জোর দাবি ওঠে। এ দাবি এক সময় আন্দোলনের রূপ নেয়, যা নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রামের সমাজসেবক ও দৈনিক পূর্বকোণের চেয়ারম্যান ইউসুফ চৌধুরী। তার এই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সিভাসুর একটি ভবনের নাম রাখা হয় “ইউসুফ চৌধুরী ভবন।”
এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ, ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি এটিকে “চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়” হিসেবে উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০৬ সালের ৭ই আগস্ট এটি আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে।প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধুমাত্র ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এটি খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং মৎস্যবিজ্ঞান নামে আরও দুটি অনুষদসহ মোট তিনটি অনুষদ নিয়ে তার একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চসভেক প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এর প্রিন্সিপাল ছিলেন অধ্যাপক নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ। বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পর তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১০ সাল পর্যন্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
য়এখন প্রশ্ন হলো, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. এ. হান্নানের নামে দুটি হল রয়েছে, ইউসুফ চৌধুরীর নামেও রয়েছে একটি ভবন, তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার অবদানের জন্য এবং আব্দুল্লাহ আল নোমানের ভূমিকার জন্য কি কোনো স্মৃতি চিহ্ন রয়েছে? পাশাপাশি, চট্টগ্রামের উন্নয়নের এক মহান নেতা চট্টলবন্ধু এস. এম. জামাল উদ্দিনের নামেও কি কিছু রাখা যেত না? আমার নিজের নামের কথা বাদ দিলাম। এমন একটি বিষয় দলীয় দৃষ্টিকোণের বাইরে রেখে অবদান কারীদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। তা না হলে, একদিন এই বৈষম্যের জন্য ইতিহাসের আদালতে জবাব দিতে হবে
ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে বিএনপি সরকার তথা আব্দুল্লাহ আল নোমানের উন্নয়ন ভূমিকা নিয়ে আরও বিস্তারিত ভবিষ্যতে লিখবো, ইনশাআল্লাহ।
লেখকঃ সাংবাদিক, গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।